আল্লামা মুফতি ছাঈদ আহমদ
॥ এক ॥
যারা হামলা চালিয়ে নির্দোষ মানুষ হত্যা করে তাদের ব্যাপারে ইসলামের বিধি-বিধানের মূলোৎস কোরআন ও হাদিস কি বলে? এ ব্যাপারে আল্লামা মুফতি ছাঈদ আহমদ এর নিকট ফতওয়া চাওয়া হলে তিনি নি¤েœাক্ত ফতওয়াটি প্রদান করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ফতওয়াটি প্রকাশ করা হল।
প্রশ্ন
বরাবর
হাকিমুল ওলামা আল্লামা
শাহ মুফতি ছাঈদ আহমদ দা. বা. (পীর সাহেব লালপোল, ফেনী)
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শাইখুল হাদীস
জামিয়া ইসলামিয়া সোলতানিয়া লালপোল, ফেনী।
জনাব,
কা-জ্ঞানহীনভাবে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষ, বিভিন্ন গাড়ি ও প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে যে বোমা হামলা করা হয় এই ধরনের কিছু বোমাবাজি এই দেশে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আর বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছুদিন পর পর গাড়ি ও প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে যে বোমা হামলা করা হচ্ছে; এতে অনেক নিরীহ ও নির্দোষ মানুষ আহত ও নিহত হচ্ছে এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এই ব্যাপারে কোরআন ও হাদীসের আলোকে বৈধতা বা অবৈধতার ফায়সালা কি?
হক্কানী ওলামায়ে কিরাম ও কওমী মাদরাসার ওলামায়ে কিরাম এটা কেমন দৃষ্টিতে দেখেন। এই ব্যাপারে তাঁরা অতীতে কী ভূমিকা পালন করেছেন এবং বর্তমানে কী ভূমিকা পালন করছেন?
প্রশ্নকারী
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, ফেনী।
তাং ১৮/০৬/২০১৬ ইং
প্রশ্নের উত্তর
নাহমাদুহু ওয়ানু সাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ থেকে রাষ্ট্র তিন প্রকার ছিল:
১. দারুল ইসলাম ২. দারুল আমান ৩. দারুল হরব।
দারুল ইসলাম: যেমন, মদীনা শরীফ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করার পর যখন মদীনার অধিকাংশ লোক ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফে আল্লাহর হুকুম আহকাম প্রকাশ্যে আদায় করেছিলেন এবং পরিপূর্ণ ইসলামী স্টেটের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তা থেকে ইসলামী স্টেটের তথা ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞাও পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল। অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র বলা হয় যাতে ইবাদত, মু‘আমালাত ও মু‘আশারাত এবং যাবতীয় বিচার ও শাসন কোরআন হাদীসের আলোকে পরিচালিত হয় ।
দারুল আমান: ঐ রাষ্ট্রকে বলা হয়, যাতে মুসলমানেরা তাদের ধর্মীয় কাজ করতে কোন প্রকারের রাষ্ট্রীয় বাধা থাকে না- যেমন, তৎকালীন হাবশা (বর্তমান নাম আবিসিনিয়া)। মক্কা শরীফে নির্যাতিত অনেক মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশে হাবশায় হিজরত করেন মদীনা শরীফে হিজরতের হুকুম আসার পূর্বে। ওখানে তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় কাজ- যেমন, নামাজ, রোজা ইত্যাদি স্বাধীনভাবে আদায় করেছেন কোন রাষ্ট্রীয় বাধা ছিল না।
দারুল হরব: ঐ রাষ্ট্রকে বলা হয়, যেখানে মুসলমানেরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মীয় কাজ করতে পারে না- যেমন, মক্কা বিজয়ের পূর্বে মক্কা নগরী ।
দারুল ইসলামের কোন নাগরিক যদি কোন শরীয়তবিরোধী জঘন্য কাজে লিপ্ত হয় এবং চুপে চুপে তওবা করে সংশোধন না হয় বরং তা প্রকাশ হয়ে যায় তাহলে তার বিচারের দায়িত্ব শাসকদের তথা ইসলামী আদালতের উপর অর্পিত হবে। সাধারণ কোন নাগরিক তার বিচার হাতে নিতে পারবে না। যা ফতওয়ায়ে শামীর নি¤েœর বক্তব্য দ্বারা পরিস্কারভাবে বুঝা যায়ঃ
“যাবতীয় দ-বিধি বাস্তবায়নের জিম্মাদার হল ইসলামী রাষ্ট্রের হাকিম বা কাযী। আর বিচার করা হয় ফাসাদ ও সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করার জন্য। কিন্তু জনসাধারণ বা পাবলিক বিচার হাতে নিলে ফাসাদ নির্মূল হবে না বরং ফাসাদ বেড়ে যাবে”।
(ফাতাওয়ায়ে শামী, কিতাবুল হুদূদ, পৃ. ১৫)
যে সমস্ত দারুল আমানে শরয়ী আদালত নেই এবং ইসলামী দ- বিধান তথা চুরির শাস্তি হাত কাটা, যিনা-ব্যভিচারের শাস্তি একশত বেত্রাঘাত বা পাথরাঘাত করে মেরে ফেলার আইন নেই- যেমন, আমাদের বাংলাদেশ। ঐ সমস্ত রাষ্ট্রে বর্ণিত ইসলামী দ- বা যে কোন প্রকারের ইসলামী দ- কোন সাধারণ পাবলিক বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কারণ ঐগুলো বাস্তবায়নের জন্য শরয়ী আমীর বা শরয়ী কাযী থাকা শর্ত। সাধারণ লোক তা করতে চাইলে ফাসাদ সৃষ্টি হবে। যার রেফারেন্স ফতওয়া শামী থেকে উপরে লিখা হয়েছে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
“যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কোন দল শরীয়তবিরোধী কোন কাজ করতে কোন ব্যক্তি বা কোন দলকে দেখে; তাহলে তাকে বা তাদেরকে পূর্ণ ক্ষমতা দ্বারা যেন সংশোধন করে দেয়। আর তাও সম্ভব না হলে মুখে (কোরআন ও হাদীসের আলোকে) বয়ান করে সংশোধন করে দেয়ার চেষ্টা করে। আর তা সম্ভব না হলে ঐ শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বা দলকে মনে মনে ঘৃণা করে ও হেদায়াতের জন্য দো‘আ করে। এটা হল ঈমানের সর্বনি¤œ স্তর”। (মুসলিম, মেশকাত-৪১১)
মুহাক্কিক ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, উক্ত হাদীসে শরীয়তবিরোধী কাজের ব্যাপারে প্রতিরোধ ও সংশোধনের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি স্তর বয়ান করেছেন। ১. পূর্ণশক্তি দ্বারা অর্থাৎ প্রয়োজনে অস্ত্র ইত্যাদি দ্বারা যথাযথভাবে প্রতিরোধ করে সংশোধন করা। এটা হল সরকারের দায়িত্ব। কারণ পাবলিক যদি অপর দোষী পাবলিককে অস্ত্র ইত্যাদি দ্বারা সংশোধন করতে চায় তাহলে সংশোধন তো হবে না বরং দেশে ফিৎনা ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। ২. কোরআন হাদীসের আলোকে মুখে বলে সংশোধন করে দেয়া বা সংশোধন করার চেষ্টা করা। এটা হল ওলামায়ে কিরামের দায়িত্ব। ৩. শরীয়তবিরোধী কাজকে অন্তরে ঘৃণা করা। এটা হল জনসাধারণের দায়িত্ব। যেহেতু সাধারণ মানুষ কোরআন হাদীস বুঝে না, তাই তারা অসৎ কাজ ও শরীয়তবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে বুঝাতে চাইলে বা বাধা দিতে চাইলে ইলম শূন্য হওয়ার কারণে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সক্ষম হবে না। বরং তারা সংশোধন করতে চাইলে সীমালঙ্ঘন করে ফিৎনা সৃষ্টি করবে। আল্লাহপাক কোরআনে পাকে বলেন: “ফিৎনা হত্যার চেয়ে অধিক মারাত্মক”। (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৭)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “সাবধান! তোমরা প্রত্যেক ব্যক্তি রাখাল তথা নিজেদের জন্য এবং নিজের অধীনস্থদের জন্য পরিচালক। হাশরের ময়দানে প্রত্যককে নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে”। (বুখারি) এটা একটা দীর্ঘ হাদীসের অংশ। উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরের মহিলার দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পর্যন্ত আলোচনা করেছেন। মোদ্দাকথা, দারুল আমানের মুসলমানগণ উক্ত তাফসীল অনুযায়ী শরীয়তবিরোধী কাজের প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করবে। সরকারের দায়িত্ব হল পাবলিকের হক ঠিকমত আদায় করা, ন্যায়বিচার করা, শরীয়তমত দেশ পরিচালনা করা এবং শরীয়তবিরোধী কাজ দেখলে যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে প্রতিহত করা ও উৎখাত করা। যদি সরকার উক্ত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে তাহলে হাশরের ময়দানে আল্লাহপাকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। আর ওলামায়ে কিরামের দায়িত্ব হল, কোরআন হাদিস অনুযায়ী সরকারকে তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে অবহিত ও সজাগ করা এবং শরয়ী বিধানানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য উপদেশ দেয়া, আর যারা কোরআন ও হাদীসবিরোধী কাজ করে তা না করার জন্য তাদেরকে সতর্ক করা এবং পাবলিকদেরকে ওয়াজ নসিহত, তা‘লীম, তাবলীগ ইত্যাদির মাধ্যমে শরীয়তের সর্বস্তরের আহকামের ব্যাপারে হেদায়েত দেয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন