শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

বোমাবাজ-সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ফতওয়া

প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আল্লামা মুফতি ছাঈদ আহমদ

॥ দুই ॥
পাবলিকের দায়িত্ব হল, ওলামায়ে কেরামের হেদায়েত অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা এবং ওলামায়ে কিরামের ডাকে সাড়া দেয়া, সমর্থন দেওয়া এবং সহানুভূতি করা।
উক্ত হাদীস দ¦ারা সাব্যস্ত হল যে, কোন পাবলিক শরীয়তবিরোধী কোন কাজ করলে সরকারের দায়িত্ব হল তাদেরকে যথাযথভাবে শাস্তি প্রদান করা। সরকার যদি শাস্তি প্রদান ও বিচার না করে তাহলে তারা আল্লাহর কাঠগড়ায় আসামী হবে। কিন্তু সরকার তার দায়িত্ব পালন না করলে পাবলিকের জন্য অস্ত্র ও বোমা ইত্যাদির মাধ্যমে বিচারের কাজ নিজ স্কন্ধে নেওয়া জায়েয হবে না। তবে কোন পাবলিক প্রকাশ্যে জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হলে ওলামায়ে কিরাম তাদেরকে অপরাধ থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিবেন এবং সতর্ক করবেন। এরপরও তারা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকলে ওলামায়ে কিরাম সাধারণ পাবলিকদের নিয়ে মৌখিকভাবে এবং লিখিতভাবে সরকারের নিকট সম্মিলিত প্রতিবাদ জানাবেন এবং দাবী রাখবেন। তাহলে ওলামায়ে কিরাম ও সাধারণ পাবলিকের দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে।
এবার আসুন মূল আলোচনাতে, গত ১৭ আগস্ট ২০০৫ সালে বাংলাদেশে বাংলাভাই ও শায়খ আব্দুর রহমান এর জে. এম. বি সংগঠনের লোকেরা একই দিনে সকল জেলায় বোমাবাজি করে অনেক মানুষ হতাহত করেছে এবং অনেক জান মালের ক্ষতিসাধন করেছে এবং এর আগে ও পরে যারা বোমাবাজি করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে যারা গাড়িতে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে বোমাবাজি করে নিরপরাধ মানুষের জান মালের ক্ষয়ক্ষতি করছে, উক্ত ঘটনাসমূহের তথ্য প্রকাশের পর প্রতীয়মান হয় যে, যারা নিহত ও আহত হচ্ছে তারা অধিকাংশই নিরপরাধ মুসলমান এবং কিছুসংখ্যক নিরপরাধ অমুসলিম। আল্লাহপাক সোবহানাহু ওয়া তা’আলা সূরা নিসার ৯৩ নং আয়াতে বলেছেন-
“যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে স্বেচ্ছাক্রমে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।”
সূরায়ে মায়েদার ৩২ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
“যে অন্যায়ভাবে অথবা পৃথিবীতে সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে।”
সূরায়ে বাকারার ১৯০ নং আয়াত দ্বারা জানা যায়, যে সকল অমুসলিম মুসলমানদের উপর হামলা করে না তাদের উপর হামলা করা সীমালঙ্ঘন ও যুলুম। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
“একজন মুসলমানকে হত্যা করার চেয়ে সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহ তা‘আলার নিকট তুচ্ছ।” (নাসাঈ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, মেশকাত শরীফ- পৃ. ৩০০)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন- “যে ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের আশ্রিত নির্দোষ অমুসলিমকে হত্যা করবে সে বেহেশতের সুবাসও পাবে না।” (বোখারী ২য় খঃ ১০২১পৃ, আবু দাউদ ২য় খঃ ৩৮০ পৃ.)
নিরপরাধ-নির্দোষ জাতি বা বিজাতিকে হত্যার ব্যাপারে কোরআন ও হাদীসসমূহে আরও অনেক জায়গায় স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। সংক্ষেপে উল্লিখিত আয়াত ও হাদীস পেশ করা হল।
এখন যারা বোমাবাজি করে নিরপরাধ মানুষকে আহত ও নিহত করছে এবং মানুষের সম্পদ নষ্ট করছে তারা প্রকাশ্য ইসলামবিরোধী কাজ করছে। তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে আল্লাহপাকের দরবারে অভিশপ্ত ব্যক্তি।
ইমাম আজম আবু হানিফা র. এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্যান্য বড় বড় ইমামগণ কোরআন হাদিসের আলোকে বলেছেন, যদি কোন মুসলমানের মুখ থেকে এমন বাক্য বের হয়ে যায় যার অর্থ একশত হতে পারে যেগুলোর নিরানব্বই অর্থ মতে তাকে কাফের বলা যেতে পারে তবে এক অর্থ মতে সে কাফের হয় না, তাহলেও তার ব্যাপারে কুফরির ফতওয়া দেওয়া জায়েয হবে না।
একদল জিহাদী মেজাজের মুসলমান ভাই মনে করেন, পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র যা আমাদের দেশে চালু আছে তা হল কুফরীতন্ত্র। তাই যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা কাফের। অনুরূপভাবে যে সমস্ত রাষ্ট্র রাজতন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে- যেমন, সৌদি আরব ইত্যাদি। এটাও কুফরীতন্ত্র। তাই রাজতন্ত্র বিশ্বাসীরাও কাফের। এভাবে সমাজতন্ত্র বিশ্বাসীরা সবই কাফের। এজন্য উল্লিখিত তিন তন্ত্রের লোকদেরকে হত্যা করা এবং হামলা করে তাদের জান মালের ক্ষতি করা জায়েয বরং সাওয়াবের কাজ। এ কারণে তারা বোমাবাজিকে জিহাদ মনে করে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের উক্তমত ভ্রান্তমত। কারণ গণতন্ত্রের অর্থ হল জনগণের স্বাধীন রায়ের মাধ্যমে সরকার গঠন করা। আর তা মুসলমানদের রায়ের মাধ্যমে খলীফা নির্বাচনের সাথে কিছুটা মিল রয়েছে।
তদুপরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহপাক সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করে কাজ করার জন্য হুকুম করেছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব ব্যাপারে স্পষ্ট ওহী নাযিল হয়নি ঐ সব ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করে কাজ করতেন। অনেক সময় পরামর্শের মধ্যে অধিকাংশের রায়কে প্রাধান্য দিয়ে ফায়সালা দিতেন। গণতন্ত্রের মূল চাহিদাও তাই। কিন্তু আজকের গণতন্ত্র মনতন্ত্রে পরিণত হয়ে গেছে। কারণ বর্তমান গণতন্ত্রের সারমর্ম হল দলীয়তন্ত্র। সমস্ত রায় নিজেদের দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে দেয়াকে বাঞ্ছনীয় মনে করে থাকে যদিও সে জালেম এবং সন্ত্রাসী হয়ে থাকে। অপর দলের প্রার্থী যদিও সভ্য ও ন্যায়পরায়ণ দ্বীনদার হয়ে থাকেন, তাকে এ দলের একটি লোকও ভোট দিবে না। শুধু তাই নয় নিজ দলের প্রার্থীকে জয়যুক্ত করার জন্য লাখ লাখ টাকা অপচয় করা হয়। অপর দলের লোককে খুন করা হয়, গুম করা হয়। অথচ ভোট হল একটি স্বাধীন রায়। অনেক জায়গায় জোরপূর্বক ভোটবাক্স ছিনতাই করা হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি বাস্তব কারণসমূহের ভিত্তিতে বর্তমান গণতন্ত্র শরীয়ত সম্মত নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে উল্লিখিত কর্মকা-ে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে ইসলামের দৃষ্টিতে জালেম এবং ফাসেক বলা যাবে। কাফের বলা যাবে না। তদ্রƒপভাবে রাজতন্ত্রও শরীয়তসম্মত তন্ত্র নয় অর্থাৎ এটি একটি নাজায়েয পদ্ধতি। কিন্তু ঐ কারণে রাজতন্ত্র বিশ্বাসীদেরকে কাফের বলে ফতওয়া দেওয়া এবং ঐ ভিত্তিতে তাদের উপর হামলা করা মোটেও জায়েয হবে না। যার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র মোটামোটি দু’প্রকার দেখা যায়। এক প্রকারের অনুসারীরা আল্লাহপাকের তথা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না এবং কোন প্রকারের ধর্ম মানে না বরং তারা ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন আরকান আহকাম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে। তারা নিঃসন্দেহে কাফের এবং নাস্তিক।
সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় গ্রুপ আল্লাহপাকের অস্তিত্ব ও ধর্মকে অস্বীকার করে না বরং তাদের অনেককে নামায রোজা পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের মূলনীতি হল মালিকানা উচ্ছেদ করা এবং সম্পদের উপর সবার সমান অধিকার স্থাপন করা। তাদের উক্ত মত ইসলামবিরোধী এবং ভ্রান্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ থেকে ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে ভূমির ব্যাপারে ব্যক্তিগত বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। সহীহ হাদীসসমূহে তার শত শত প্রমাণ রয়েছে। এক সহীহ হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির মালিকানা জমিন থেকে জোরপূর্বক এক বিঘত জমিন দখল করে নিবে হাশরের ময়দানে ঐ দখলকৃত জমিনের উপরের অংশ থেকে সাত তবকার নিচতলা পর্যন্ত যত লাখ টন মাটি হবে সবটা মিলিয়ে তার ঘাড়ে বেঁধে দেওয়া হবে। আর বলা হবে এটা টেনে নিয়ে যাও। সে জালেম বলবে এটা কি আমার পক্ষে টানা সম্ভব? তখন ফেরেস্তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকরের শাস্তি দেয়া হবে। আর বলা হবে টানতে না পারলে দুনিয়াতে অপরের জমিন ঠেলে নিয়েছ কেন? মোদ্দাকথা, ইসলাম মালিকানা রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন