চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের প্রাক্কলন ২ হাজার ২২৭ ডলার। এদিকে ভারতের হালনাগাদ তথ্য বলছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী লকডাউনের প্রভাবে দেশটির মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৪৭ ডলার। এ হিসাবে মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে মাথাপিছু আয়ে ভারতকে বাংলাদেশের ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেশটির সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ামকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, সংখ্যাগুলো তুলনাযোগ্য নয়। সময় ও এলাকাভেদে কল্যাণমূলক কার্যক্রমের তুলনার জন্য বাজার বিনিময় হার বিবেচনা যথার্থ নয়। এতে করে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি অথবা উৎপাদনশীলতার চিত্র সঠিকভাবে ফুটে নাও উঠতে পারে। স্থিরমূল্যে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), ক্রয়ক্ষমতার বিনিময় হার তুলনা করা সমীচীন, যা বিবেচনায় নিলে ভারত এগিয়েই থাকবে।
মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তবে তাদেরও মতামত হলো, তুলনা যথার্থ হবে ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনার নিরিখে। মাতৃমৃত্যু হার, শিশুদের টিকা প্রদান কার্যক্রম, প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলেমেয়ের পার্থক্য এমন বেশকিছু আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত থেকে ভালো আছে। কিন্তু দুই দেশের অর্থনীতির আকারে ভিন্নতা অনেক বড়। বাংলাদেশের যেখানে সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি সেখানে ভারতের ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের। ক্রয়ক্ষমতায় পার্থক্যটা আরো বেশি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পরিসংখ্যানগুলো বাজারমূল্যের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়। ক্রয়ক্ষমতার বিচারে দেখলে হয়তো ভিন্ন চিত্র পাওয়া যাবে। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি খারাপ, করোনার কারণে দেশটির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০ শতাংশ। কোভিড চলে গেলে ভারতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের এ পার্থক্য নিয়ে খুব বেশি উল্লসিত বা উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ নেই। এর পেছনে যুক্তি হলো মাথাপিছু আয় গড় চিত্র তুলে ধরছে। আমাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর বিষয়টি যদি খতিয়ে দেখি, সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলোয় এটা ১৯-২৩ শতাংশ। কোনো কোনো সমীক্ষায় ৪০ শতাংশের হিসাবও বলা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজের সুযোগের ক্ষেত্রটি এখন অনেক বড়। দারিদ্র্যসীমার নিচে যে বেশি মানুষ যাচ্ছে, অর্থাৎ দারিদ্র্য বিমোচনের যে অবনতি হচ্ছে, সেটা কীভাবে প্রতিহত করতে পারি সেই দিকটায় দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। দুই দেশের তুলনামূলক অবস্থানটি আরো স্পষ্ট হবে ক্রয়ক্ষমতার বিচারে। বণ্টন বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। করোনার কারণে আয়, ভোগ ও সম্পদের বৈষম্য আরো বেড়েছে। সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে বণ্টন বড় সমস্যা।
ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে ভারত এগিয়ে এমন তথ্য উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা প্রতিফলন। কিন্তু ভারতের সঙ্গে তুলনাটা ঠিক না হওয়ার কারণ হলো গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক, প্রায় ১০ শতাংশের মতো। কিন্তু এটা আবার পাল্টে যেতে পারে এমন ধারণা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যে পার্থক্যটা এবার আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগামীতে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাবে। সাধারণত ভারতে পণ্যসামগ্রী তুলনামূলক সস্তা। সুতরাং ক্রয়ক্ষমতার বিচারে ভারত এখনো বাংলাদেশের উপরে। আবার কেবল ক্রয়ক্ষমতা দেখলে হবে না, বণ্টনও দেখতে হবে।
বণ্টন বিবেচনায় বাংলাদেশে আয়বৈষম্য ২০১০ থেকেই বাড়ছে এমন পর্যবেক্ষণ জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার কারণে আয়, ভোগ, সম্পদবৈষম্য আরো বেড়েছে। তাই আমাদের কেবল মাথাপিছু আয় দেখা উচিত না। বণ্টনে নজর দিতে হবে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তার দেয়া তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাক্কলিত হিসাবে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা বা ২ হাজার ২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২৪ ডলার। ফলে এক অর্থবছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ১১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে দেশের জিডিপি ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, দেশের অর্থনীতি মহামারীর কারণে চাপে রয়েছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে সে চাপ মোকাবেলা করেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সব প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ফলে অর্থনীতির নানা সূচকে উন্নতির তথ্য উঠে এসেছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন