শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পাহাড়ে মৃত্যু ঝুঁকিতে বসবাস

চট্টগ্রামে বেপরোয়া দখলদাররা বর্ষা এলেই প্রশাসনের তোড়জোড়

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২১, ১২:০১ এএম

চট্টগ্রামে প্রশাসনের নানা তোড়জোড়েও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরানো যাচ্ছে না। সরকারি হিসাবে মহানগর ও জেলার ছোটবড় ৩৪টি পাহাড়ে এখনও লাখো মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাস করছে। ভারী বর্ষণ হলেই পাহাড়ের বসতি উচ্ছেদ আর লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। তবে কিছুদিন পর সবকিছু চলে আগের মতো। পাহাড়খেকো দখলদারেরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ফলে বন্ধ হয় না পাহাড় কর্তন, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ। এখনও মহানগরী এবং জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়-টিলা উজাড় করে মাটি লুট ও জমি দখল চলছে। নতুন নতুন পাহাড়ে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। এতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশপাশি পাহাড় ধসে প্রাণহানীর ঝুঁকি বেড়েই চলেছে।
পাহাড় সুরক্ষা যাদের দায়িত্ব তারাও নির্বিচারে পাহাড় নিধন করছে। ছোটবড় ১৫টি পাহাড় কেটে ৩৩২ কোটি টাকায় নির্মিত ফৌজদারহাট-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক পাহাড় ধসের আশঙ্কায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- সিডিএর এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই সড়কের দুইপাশে পাহাড় কেটে শুরু হয় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ। সেখানে এখনও চলছে নির্বিচারে পাহাড় দখল।

নগরী ছাড়িয়ে দখলদারদের ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে জেলার সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকায় সরকারি দলের নেতা, ক্যাডার, মাস্তানদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। পাহাড়ের কোলে এসব মৃত্যুকূপে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছে নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে বর্ষায় ভারী বর্ষণে এবারো প্রাণহানির আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।

বিগত ২০০৭ সালের ১১ জুন একদিনের ভারী বর্ষণে ব্যাপক পাহাড় ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানীর পর চট্টগ্রামের পাহাড় সুরক্ষায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই ‘শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গত ১৪ বছরে ২১টি সভা করেছে। তবে একটি পাহাড়কেও দখলমুক্ত কিংবা একজন দখলদারের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকারি এই কমিটি। নতুন পাহাড় দখলও বন্ধ হয়নি। বরং সরকারি সংস্থাও পাহাড় কাটছে। সিডিএ বায়েজিদ- ফৌজদারহাট সংযোগ সড়ক তৈরি করতে গিয়ে ১৫টি পাহাড় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কেটে ফেলে। এজন্য তাদের পরিবেশ অধিদফতর থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।

তবে পাহাড় কাটার খেসারত হিসাবে পুরোপুরি চালুর আগেই সড়কটি তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে দুই দিনের ভারী বর্ষণে সড়কের দুই পাশে বেশ কয়েকটি পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটে। আর তাই প্রাণহানির আশঙ্কায় সড়কটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে সড়কটি বন্ধ থাকলে সড়কের দুইপাশে পাহাড়ে দখলবাজি অব্যাহত আছে। সেখানে গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। গত বছর জেলা প্রশাসন ও পরিবশে অধিদফতরের যৌথ অভিযানে আড়াই শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তবে এবছর কোন উচ্ছেদ অভিযান হয়নি সেখানে।
এদিকে এবারও ভারী বর্ষণে নগরীর মতিঝর্ণা এলাকাসহ বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত অনেক পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গত ২৮ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ সব ঘরের অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। প্রশাসনের হিসাবে নগরীতে ১৮টি ও জেলায় ১৬টিসহ মোট ৩৪টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে লোকজন বাস করছে। তারমধ্য নগরীর সব কয়টি এবং সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর ও হাটহাজারী মানাই ত্রিপুরা এলাকার কয়েকটি পাহাড় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব পাহাড়ে কয়েক লাখ মানুষ বাস করছে। পাহাড় কেটে নির্মাণ করা এসব ঘরে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। একটি মিটার থেকে ১০-১২ ঘরে দেয়া হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ।

সেবা সংস্থাগুলোর এক শ্রেণি কর্মকর্তা কর্মচারীর সহযোগিতায় দখলদারের এসব সুবিধা পাচ্ছেন। নিম্ন এবং স্বল্প আয়ের লোকজনও অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় এসব ঘরে থাকতে পারছেন। এসব অবৈধ স্থাপনা ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে দখলদারেরা। আর তাই এই বাণিজ্য রক্ষায় তারা ঐক্যবদ্ধ। উচ্ছেদ অভিযানে কয়েক দফা হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতাদের একসাথে রাস্তায় দেখা গেছে। নগরীর লালখান বাজারে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের প্রতিবাদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা সড়ক অবরোধ করেছিলেন। আবার উচ্ছেদ শুরু হলেই উচ্চ আদালতে গিয়ে রিট করেন তারা। রিটের কারণেও অনেক পাহাড়ে উচ্ছেদ করা যাচ্ছেনা বলেও জানান প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
অপরদিকে, নির্বিচারে পাহাড় নিধন অব্যাহত থাকায় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। সামান্য বৃষ্টি হতেই পাহাড়ী ঢলের সাথে নেমে আসা বালু আর কাদা মাটিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাল-নালা-নর্দমা। এতে পানিবদ্ধতা আরও বাড়ছে। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর গঠিত বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি চট্টগ্রামের পাহাড় সুরক্ষায় ৩৮ দফা সুপারিশ দিয়েছিল। সেই সুপারিশের কোনটিই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পাহাড় কর্তন ও নিধন এবং সেইসাথে প্রতিবছর পাহাড় ধসে বেঘোরে মৃত্যুর ঘটনা থামানো যাচ্ছে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন