বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে নারীমুক্তি, মানবমুক্তি এবং গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামালের ১১০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে আজ (রোববার) অনলাইনে স্মারকবক্তৃতা, কবি সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রদান ও সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। অনূষ্ঠানের শুরুতে শ্রদ্ধা জানিয়ে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ান।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। ‘সুফিয়া কামাল ও বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলন’ শীর্ষক স্মারকবক্তৃতা প্রদান করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। অনুষ্ঠানে কবি সুফিয়া কামাল সম্মাননা-২০২০ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয় সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও আন্দোলনকর্মী নূরজাহান মুরশিদকে এবং কবি সুফিয়া কামাল সম্মাননা-২০২১ প্রদান করা হয় জনকল্যাণমূলক সংগঠন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সমাজবিকাশের বহুমাত্রিক কর্মকান্ডের নেতৃত্বদানকারী এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সভাপতি কবি সুফিয়া কামালের আজ ১১০তম জন্মবার্ষিকী। সংগঠনের দেড় লাখ সদস্যের পক্ষথেকে আজ তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। দুই যুগের বেশি সময় তিনি আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই কিন্তু তিনি আমাদের সকল কর্মে, চিন্তা ও ভাবনায়, আনন্দে ও সংকটে জড়িয়ে আছেন। মানবমুক্তির এই সাধক, গণতন্ত্রের, সাম্প্রদায়িকতার লড়াইয়ের অকুতোভয় এই সৈনিক সমাজের সকল ধরণের অনাচার, অন্যায্যতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, উচ্চকন্ঠ হিসেবে আজীবন নারী-পুরুষের সমতা, নারীর মর্যাদার জন্য লড়াই করে গেছেন। একটা পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থায় রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়েছেন, নিজের বিবেক বোধকে জাগ্রত করেছেন তাকে সমুন্নত রেখেছেন এবং তার সময়ের আলোকিত মানুষ রবীন্দ্র, নজরুল, রোকেয়া, নাসির উদ্দীন শাহ তাদের সংস্পর্শে এসে নিজেকে তিনি উজ্জীবিত করেছেন।তিনি বহুমানুষকে সংগঠিত করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। যারা তার চিন্তা চেতনার বাস্তবায়নে কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন তাদের অবদানকে মহিলা পরিষদ সবসময়ই গৌরবের সাথে ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
"সুফিয়া কামাল ও বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলন" শীর্ষক স্মারকবক্তৃতা প্রদান করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। তিনি বলেন আমাদের জাতির আশা প্রশ্বাস এর নাম কবি সুফিয়া কামাল। তিনি জন্মেছিলেন অবরুদ্ধ পরিবেশে। আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে তিনি যেভাবে নারীর মুক্তির কথা ভেবেছেন, মানুষকে সংগঠিত করেছেন তা ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। আজ নারীবাদের যে তাত্বিক কাঠামো তা সুফিয়া কামালের সময়ে ছিলনা, অথচ তিনি সমাজের বিকাশের চেয়ে নারীর বিকাশকে বড় করে দেখেছেন। সুফিয়া কামাল কবিতার মাধ্যমে কিভাবে তার নারীবাদী চেতনা বিকশিত হয়েছে তা তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি দীর্ঘ ৭০ বছরে কেবল কবিতা চর্চা করেছেন, নারীর জাগরণের সংগ্রামে এক শক্তির প্রতীক। তিনি নানা বিষয়ে কবিতা লিখেছেন এবং বাংলা কবিতার ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি নারীদের জ্ঞানার্জনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করতেন নারীর মুক্তির জন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীরা এগিয়ে আসলেই সম্ভব সমাজের পুর্ণজাগরণ। পুরুষতন্ত্রকে উপেক্ষা করে তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে নারীকে সমৃদ্ধির পথে, মুক্তির পথে, কল্যাণের পথে আহ্বান জানিয়েছেন।
স্মারকবক্তৃতা প্রদান শেষে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল।
কবি সুফিয়া কামাল সম্মাননা-২০২০ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয় সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও আন্দোলনকর্মী নূরজাহান মুরশিদকে। এসময় সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তির পরিচিতি পাঠ করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মারুফা আক্তার।
সম্মাননা প্রদান শেষে প্রয়াত নূরজাহান মুরশিদের পরিবারের সদস্য তাজিন মুরশিদও শারমিন মুর্শিদ স্মৃতিচারণ করে বলেন তিনজন পুরুষ (তার বাবা, শ্বশুর মশাই এবং তার স্বামী)গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মায়ের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে নিতে। । মায়ের মত অনেকে আছেন তাদের জীবন, কর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। সুফিয়া কামালের সাথে মায়ের চিন্তাভাবনার অনেক মিল ছিল তাই একসঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন।
কবি সুফিয়া কামাল সম্মাননা-২০২১ প্রদান করা হয় জনকল্যাণমূলক সংগঠন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে। সম্মাননাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবাহুতি চক্রবর্তী। নারী শিক্ষা ও নারী স্বাস্থ্য বিষয়ে গত সাত দশক ধরে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকেএই সম্মাননা দেয়া হয়।
কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট্রের পরিচালক শ্রীমতি সাহা বলেন উনাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়। উনি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে পথ দেখিয়েছেন সেই পথ অনুসরণ করে আজও আমরা চলছি। কুমুদিনী কাজ করে যাচ্ছে মেয়েদের জন্য।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট্রকে এবং প্রয়াত নূরজাহান মুরশিদকে সম্মাননা দিতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। বিশ শতাব্দীর পর নানাভাবে নারী আন্দোলন প্রকাশ পেয়েছে। জেন্ডার বিষয় আজ সামাজিক দর্শনের একটা বিষয় হয়েছে। ব্যাপক সামাজিক উপজীব্য হয়ে দাড়িয়েছে। নারীবাদী আন্দোলনের ইস্যূ আজ নানাভাবে বিস্তৃত। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে মহিলা পরিষদ গড়ে ওঠার পর যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় আজও তা চলমান আছে। এসময় তিনি নারী স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, সহিংসতা প্রতিরোধে সংগঠনের নেয়া গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন নারীবাদ আন্দোলন কখনো এক সরলরেখায় চলে না। মহিলা পরিষদের চলার ধারাও তেমন পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলন অগ্রসর করতে সংগঠন সবসময় সুফিয়া কামালের দেখানো পথই অনুসরণ করবে। নারীর জীবনে আজ নানা সক্ষমতা অর্জন হয়েছে কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পরিবর্তন হয়নি। এর জন্য সংগ্রামের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। নারী উন্নয়নের লক্ষ্যবস্তু না উন্নয়নের বিষয় সেটি আমাদের দেখতে হবে। নারী যখন উন্নয়নের অংশীদার তখন নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে, এগিয়ে যেতে দেয়ার পরিবর্তে নানা ভাবে পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন অবস্থা প্রতিরোধে নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী সকল প্রতিষ্ঠানকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
অনলাইন অনুষ্ঠানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, প্রয়াত নূরজাহান মুরশিদের পরিবারের সদস্য, কবি সুফিয়া কামালের পরিবারের সদস্য, কুমুদিনী ট্রাস্টের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক এবং কর্মকর্তা সহ ৭০জন উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন