দুই বছরের পথচলায় সেরা দুইয়ে জায়গা করে নেওয়ার তীব্র লড়াই, অনেক চড়াই-উৎরাই, অনিশ্চয়তা-উত্তেজনার নানা মোড় পেরিয়ে আইসিসি আয়োজিত প্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা লড়াইয়ে শীর্ষ দুই দল ভারত-নিউজিল্যান্ড। তাতে বিন্দুমাত্র কমতি ছিলনা উত্তেজনার রসদে ঠাঁসা। ট্রফির ফয়সালা পৌঁছে ফাইনালের রিজার্ভ ডের শেষ সেশনের শেষ ঘণ্টায়। তাতে রঙ ছড়ানো এক লড়াইয়ে ভারতের দর্পচূর্ণ করে টেস্টে বিশ্বসেরার রাজদন্ড নিজেদের করে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনের রোজ বোলে বুধবার শেষ হওয়া ম্যাচটি ৮ উইকেটে জিতেছে কেন উইলিয়ামসনের দল।
জয়ের কৃতিত্ব নিউজিল্যান্ডকে দিলেও দুই বছরের লড়াই শেষে এক ম্যাচের ফাইনালেই সেরা দলের ফয়সালা মানতেই পারছেন না বিরাট কোহলি। ভারতীয় অধিনায়কের মতে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হওয়া উচিত ছিল নিদেনপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজ। তবে বিজয়ী দলপতি উইলিয়ামসন অবশ্য পুরোপুরি একমত নন এখানে। কিইউ অধিনায়কের মতে, এক ম্যাচের ফাইনালই ছিল দারুণ রোমাঞ্চকর।
দুটি পুরো দিন বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পর সাউদাম্পটনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল দেখেছে জয়-পরাজয়। আবহাওয়ার কথা ভেবেই ঠিক করে রাখা ষষ্ঠ দিনে (রিজার্ভ ডে) ভারতকে ৮ উইকেটে হারিয়ে প্রথম আসরের সেরা হয়েছে নিউজিল্যান্ড। শেষ দিন শেষ সেশন শুরুর সময়ও ম্যাচে সম্ভব ছিল যে কোনো ফল। শেষ পর্যন্ত কিউইরা জিতে যায় নিনের খেলা ৭.১ ওভার বাকি থাকতে। রোমাঞ্চ থাকলেও এই একটি ম্যাচেই ট্রফির ভাগ্য নির্ধারণ নিয়ে ম্যাচ শেষে খেদ জানালেন কোহলি, ‘এক ম্যাচ দিয়েই টেস্টের বিশ্বের সেরা টেস্ট দল বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় আমি একদমই একমত নই। টেস্ট সিরিজ যদি হয়, তিন ম্যাচ জুড়ে দলের চরিত্র ফুটে ওঠে... কোন দলের সামর্থ্য আছে সিরিজে ফিরে আসার বা প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার। স্রেফ দুটি দিনের চাপের পর হুট করে কোনো দল আর ভালো টেস্ট দল নয়, এটা হতেই পারে না। আমি এটা বিশ্বাসই করি না।’
কারণ ব্যখ্যা করতে গিয়ে ম্যাচের পর ভারত অধিনায়ক বলছেন, ফাইনালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই প্রয়োজন অন্তত তিন ম্যাচের সিরিজ, ‘এই খেলাটাই দেখুন, যেভাবে এগিয়েছে, যতটা সময়ই আমরা পেয়েছি, আপনি কেন চাইবেন না আরও দুটি টেস্টে দুই দলের লড়াই চলুক এবং তার পর টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের যোগ্য বিজয়ী নির্ধারিত হোক! ইতিহাস যদি দেখেন, যতগুলি অসাধারণ টেস্ট সিরিজ হয়েছে, তিন ম্যাচ বা পাঁচ ম্যাচ ধরে তাদের লড়াই লোকে মেনে রেখেছে ও সিরিজগুলি স্মরণীয় হয়ে আছে। এটি অবশ্যই চালু করা উচিত। এমন নয় যে আমরা জিততে পারিনি বলে এসব বলছি। আমি বলছি টেস্ট ক্রিকেটের স্বার্থেই এবং এই লড়াই অন্তত তিন ম্যাচ ধরে হওয়া উচিত যেন এটি সত্যিকার অর্থেই স্মরণীয় কিছু হয়। তাতে চড়াই-উৎরাই থাকবে, মানসম্পন্ন দুটি দল নিজেদের উজাড় করে ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
এক ম্যাচের ফাইনালে হৃদয় ভাঙার অভিজ্ঞতা কম নেই উইলিয়ামসনের। ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে তারা ছিল হেরে যাওয়া দলে। ২০১৯ আসরের ফাইনালে মূল ম্যাচ ও সুপার ওভার টাই হওয়ার পর তারা ট্রফি পায়নি স্রেফ বাউন্ডারি সংখ্যায় পিছিয়ে থাকায়। তার পরও এক ম্যাচের ফাইনালের রোমাঞ্চই তার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কোহলির মতামত নিয়ে ম্যাচের পর জানতে চাওয়া হলে উইলিয়ামসন দেখালেন মুদ্রার উল্টো পিঠ, ‘এই ফাইনালের (এক ম্যাচের) রোমাঞ্চকর দিক হলো, যে কোনো কিছুই হতে পারে। আমরা ভালো করেই জানি, ক্রিকেট কতটা অস্থির হতে পারে, বিশ্বকাপসহ অন্যান্য অনেক জায়গায় আমরা সেসবের নমুনা দেখেছি। একটি ম্যাচই হলে তা অনন্য এক নাটকীয়তা তৈরি করে, যা খুবই উত্তেজনাময়। যে কোনো দিন যে কোনো কিছু হতে পারে।’
ফাইনালের আগে আইসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী জেফ অ্যালারডাইস বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঠাসা স‚চিতে ফাইনালে তিন ম্যাচের সিরিজ করা কঠিন। উইলিয়ামসনও এই যুক্তিতে একমত, ‘দুই দিকেই যুক্তি আছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই সূচি। এমনিতেই যত ক্রিকেট খেলা হয় এখন, এসবের মধ্যে আরেকটি সিরিজ করা কঠিন। অবশ্যই এতে কোনো কোনো সন্দেহ নেই যে, কোনো সিরিজে যত বেশি ম্যাচ হয়, ততই তা উন্মুক্ত হয় ও অনেক কিছু ফুটে ওঠে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাই বলতে হবে, এই ম্যাচ খুব রোমাঞ্চকর ছিল। প্রথমবারের মতো এরকমের একটি প্রতিযোগিতা হয়েছে, দুই দলই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং দারুণ খেলা হয়েছে।’
কোহলির এই ‘মামা বাড়ির আবদার’ চোখ এড়ায়নি ভারতের সবচেয়ে বড় সমালোচক বলে খ্যাত কিংবদন্তি মাইকেল ভন। কোহলির এমন ‘অপরিপক্ক’ মন্তব্যে টুইটার সরগরম করে রেখেছেন সাবেক এই ইংলিশ অধিনায়ক। ভারতের অধিনায়কের এই মন্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে কোহলিকে খোঁচাও দিয়েছেন ভন। কোহলির কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন, আইপিএলের সময় কমিয়ে ফাইনালের তিন ম্যাচ আয়োজন করা হবে কিনা! ঐ টুইটে ভন লিখেন, ‘কিভাবে এই সূচি নির্ধারিত হবে? ফাইনালের বছর কি আইপিএল দুই সপ্তাহের জন্য কমিয়ে আনা হবে, যেন ঐ সময়টাতে সূচি নির্ধারণ করা যায়? এই ব্যাপারে সন্দেহ আছে।’ ভনের সাফ কথা। ফাইনাল হতে হবে এক ম্যাচেরই। নির্ধারিত ঐ এক ম্যাচেই ভালো খেলতে হবে। তবেই তো সেই দল বা ব্যক্তিদের ‘গ্রেট’ বলা যায়, ‘ফাইনাল একটি ম্যাচেরই হয়, যেখানে ব্যক্তি বা দলকে সেরাটা দিতে হবে। এটাই তাদেরকে গ্রেট বানিয়ে দেয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন