দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিভিন্ন জনের অন্তত ঃ ৮০০ কোটি টাকা (৭শ’ ৮৩ কোটি টাকা) জব্দ করে রেখেছে। মামলা এবং রায় দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে এ অর্থ। অথচ এ অর্থ এবং সম্পত্তি সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। যার টাকা তিনিও খরচ করতে পারছেন না। বরং জব্দকৃত অর্থ থেকে একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে জানা গেছে। স্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করছে বিভিন্নজন। দুর্নীতি মামলায় ‘বাজেয়াপ্ত’ অর্থসম্পদ নিজেদের কবজায় নিতে দুদক একটি ইউনিট গঠন করে। কিন্তু রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হওয়া সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের নীতিমালা না থাকা এবং পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না সেই ইউনিট।
আদালত সূত্র জানায়, আদালত রায়ের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দুর্নীতিলব্ধ অর্থ-সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে। কখনো বা মামলা বিচারাধীন অবস্থায় দুর্নীতিলব্ধ অর্থসম্পদ জব্দও করা হয়। বাজেয়াপ্ত এবং বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তি সরকার তথা সরকার ভোগ-দখল করতে পারছে না। স্থাবর সম্পত্তিগুলো চলে যায় প্রশাসকের জিম্মায়। নগদ অর্থ ব্যাংকে বছরের পর বছর থাকে ‘জব্দ’ অবস্থায়। রাষ্ট্রের সম্পদ কাজে লাগাতে পারে না রাষ্ট্র। অব্যবহৃত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন মামলায বিচারিক আদালতে জয়লাভ করে বটে, কিন্তু সংস্থাটি রায়ের একটি কাগজ ব্যতীত সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্রই হাতে পায় না। রায়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর রাষ্ট্রের কার্যকর মালিকানা প্রতিষ্ঠা, ভোগদখল, সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার ও ভোগদখল নিশ্চিত হলো কি না দেখার নেই কেউ। জব্দকৃত সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের ঘরে উঠছে না দুর্নীতি দমনের চূড়ান্ত অর্জন। এ বাস্তবতায় রাষ্ট্রের সম্পদ রাষ্ট্র যাতে ব্যবহার কিংবা খরচ করতে পারেÑ বছর তিনেক আগে একটি উদ্যোগ নেয় দুদক। এ লক্ষ্যে গঠন করা হয় একটি ‘অ্যাসেট রিকভারি ও ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’। কিন্তু সেই ইউনিটের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি তিন বছরেও।
দুদক সূত্র জানায়, গত ৬ বছরে ১১শ’ ৫৭টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে শাস্তি হয়েছে ১৮৯টি মামলার। দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা পেয়েছে ১ হাজার ৪৭ জন আসামি। তারা কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হয়েছে। তাদের কাছ থেকে দুর্নীতিলব্ধ ৭শ’ ৮৩ কোটি টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে জরিমানালব্ধ ২১ কোটি টাকাও রয়েছে। আরো আছে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার টাকার সম্পত্তি। একই ব্যক্তির রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরে ৫ কাঠা প্লটের ওপর ৬ তলা ভবন, রূপগঞ্জে ১শ’ একরের বেশি কৃষিজমি রয়েছে। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত কৃষিবিদ ও বিএনপি নেতা জাভেদ ইকবালের রয়েছে নগদ ২৫ কোটি টাকা।
রায়ের পর এসব অর্থের আইনগত বৈধ মালিক এখন রাষ্ট্র। অথচ অর্থগুলো কখনো সরকারের ট্রেজারিতে জমা হয় না। দণ্ডিত আসামিদের একাউন্টেই এখন পর্যন্ত ‘জব্দ’ অবস্থায় রয়েছে। এ অর্থ অ্যাকাউন্টের মালিক উত্তোলন করতে পারছেন না। বিনষ্ট হচ্ছে জব্দকৃত স্থাবর সম্পত্তিও। এর বাইরে বিচারাধীন দুর্নীতির মামলার কারণে আইনি জটিলতায়ও বিনষ্ট হচ্ছে শত শত কোটি টাকার জব্দকৃত সম্পত্তি। মামলার বিচারই শুরু হয়নি। শুধুমাত্র ‘তদন্তাধীন’ এমন পর্যায়েও জব্দ করে রাখা হয়েছে অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতির অর্থ-সম্পদ। এর মধ্যে বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার ১০টি এফডিআর, ৩২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ রয়েছে।
একাধিক মামলায় দণ্ডিত হয়ে কুয়েতের কারাগারে আটক কাজী শহিদ ইসলাম, তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের নামে ৩০ দশমিক ২৭ একর জমি এবং গুলশানের ফ্ল্যাট জব্দ অবস্থায় রয়েছে। এনআরবিসি ব্যাংকে ৫৯০টি, প্রাইম ব্যাংকে ১৩টি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে চারটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে দুটি এবং সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এগুলোতেও রয়েছে কোটি কোটি টাকা। কাজী পাপুলের বিরুদ্ধে ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। দুদক তদন্ত করছে অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলার। এসব সম্পত্তি কি অবস্থায় রয়েছে এর কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই দুদকের হাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, তদন্তাধীন এবং বিচারাধীন মামলায় জব্দ থাকা শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হচ্ছে। এসব সম্পত্তির কোনো কোনোটিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। কিছু সম্পত্তিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে পুলিশকে। বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির পুলিশি-পরিচালনার মাঝেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সম্পত্তির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। অকেজো ও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অব্যবহৃত রয়েছে বহু সম্পত্তি।
সূত্রমতে, বহুল আলোচিত এমএলএম কোম্পানি ‘ডেসটিনি-২০০০ লি:’র রয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পত্তি। রাজধানীর ফার্মগেটে ‘আনন্দ’ ও ‘ছন্দ’ নামে দুটি সিনেমা হল, প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন বিমান কোম্পানি ‘বেস্ট এয়ার’র একটি এয়ারবাস কক্সবাজার এয়ারপোর্টে পড়ে আছে অকেজো অবস্থায়। রাজবাড়িতে রয়েছে নিহার জুট মিল। কুমিল্লার বুড়িচং দয়ারামপুর এলাকায় সিলগালা অবস্থায় রয়েছে ‘বন্দীশাহী কোল্ডস্টোরেজ’ এবং একটি পুকুর। রাজধানীর কাকরাইলে ১৭ বিঘার একটি প্লট। শতকোটি টাকা মূল্যের এ প্লটে ‘রোজা প্রপার্টিজ’র সাইনবোর্ড ঝুলছে।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ডেসটিনির কেনা ১৩শ’ বিঘা জমি। দেখভাল করার মতো আইনানুগ কেউ না থাকায় স্থানীয়রা মাটি কেটে নিয়ে গেছে। বরিশাল ও খুলনায় রয়েছে দুটি ভবন। রাজশাহীর বর্ণালী সিনেমা হল, বান্দরবানে সুয়ালক, রাজবিলা, লামার ফাঁসিয়াখালি, ইয়াংছা, আজিজনগর, ফাইতং এলাকা রয়েছে ৮৩৫ একর জমির ওপর ৩৪টি বাগান। এছাড়া ৫৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জব্দ অবস্থায় রয়েছে নগদ দেড়শ’ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগাসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে এ অর্থও নানাভাবে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ডেসটিনি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া বিচারাধীন মামলায় ‘হলমার্ক গ্রুপ’র শত শত কোটি টাকার সম্পত্তিও বিনষ্ট হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় ২২৭ বিঘা সম্পত্তি ছিলো প্রতিষ্ঠানটির। এর ওপর ছিল নির্মাণাধীন কিছু ভবন। এর মূল্য প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার মতো। এছাড়া সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক গ্রুপের বন্ধকী সম্পত্তি ছিল ২ হাজার কোটি টাকায়। পরে সোনালী ব্যাংক এর মালিকানা দাবি করলেও দুদকের ১৬টি মামলার আলামত হিসেবে সম্পত্তিগুলো জব্দ রয়েছে। সাভার হেমায়েতপুর, হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর রোডের তেঁতুলঝোড়া ব্রিজের দুইপাশে অবস্থিত ডেসটিনির এসব সম্পত্তি দেখভালের অভাবে বিনষ্ট হয়ে গেছে। নির্মাণাধীন ভবনগুলো এখন মাদকসেবীদের আখড়া। বিভিন্নজন ভোগ-দখল করে খাচ্ছে।
দণ্ডিত মামলায় বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি এবং বিচারাধীন মামলায় জব্দ থাকা সম্পত্তির ভোগ-দখল ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে দুদকের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মইদুল ইসলাম বলেন, বিধান অনুযায়ী দুর্নীতি মামলায় রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হওয়া অর্থ-সম্পত্তির বৈধ মালিক রাষ্ট্র। এ অর্থ-সম্পত্তির ওপর রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানা। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে সম্পত্তি নিজে ভোগ-দখল, বিক্রি কিংবা ইজারা প্রদান করতে পারে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতি মামলায় বিচারে দণ্ডিত দুর্নীতিবাজের অর্থ-সম্পদের ওপর রাষ্ট্র মালিকানা পাচ্ছে কাগজপত্রে। রাষ্ট্র এ অর্থ-সম্পদ ভোগ-দখল করতে পারছে না। প্রয়োজনে কাজেও লাগাতে পারছে না। এমনকি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হওয়া অর্থ-সম্পদ প্রকারন্তে দণ্ডিত ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণেই থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ছে না। ফলে দুর্নীতি মামলায় দোষী ব্যক্তির দণ্ডের কার্যকরিতা থাকছে না। দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। এ বাস্তবতা থেকেই দুদক ‘এসেট রিকভারি এন্ড ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ করেছিল। পরবর্তীতে এটি কেন কার্যক্রম শুরু করতে পারল নাÑ আমার জানা নেই।
এদিকে দুদকের ‘এসেট রিকভারি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ নিয়ে তৈরি হয়েছে ত্রি-শঙ্কু অবস্থা। ইউনিট গঠন করা হলেও এটি কিভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবেÑ স্পষ্ট নয়। কোনো নীতিমালাও নেই। দেখা গেল বিচারিক আদালত একটি মামলায় দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তির ‘অবৈধ সম্পদ’ বাজেয়াপ্ত করল। বাজেয়াপ্ত করার আদেশ হাতে নিয়ে দুদক ওই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করছে। কিন্তু পরক্ষণেই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে যখনই দণ্ডিত ব্যক্তি আপিল করলেনÑ তখন ওই সম্পত্তির জব্দাদেশও স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। এতে সম্পত্তির ওপর কেউ মালিকানা দাবি করতে পারছেন না। অমীমাংসিত অবস্থায় পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। অন্যদিকে জব্দৃকত সম্পত্তি আয়ত্বে আনতে কোথায়, কার কাছে যেতে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় কি করতে হবেÑ স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে। জানা গেছে, দুদকের এসেট রিকভারি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ এ একজন পরিচালককে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ইউনিটটি কোনো কাজই করতে পারছে না। এটিকে বিলুপ্ত কিংবা সক্রিয় করার কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন