বিশেষ সংবাদদাতা : ধর্মশালায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জিতে ড্রেসিংরুমে হাসি-খুশি বাংলাদেশ দল একটি দু:সংবাদে নিমিষেই হয়ে গেল স্তম্ভিত! ম্যাচ শেষে ম্যাচ রেফারী এন্ডি পাইক্রফট যখন টীম ম্যানেজার খালেদ মেহমুদকে ডেকে জানালেন দুই আম্পায়ার এস রবি এবং রড টাকারের সন্দেহের তীর পেস বোলার তাসকিন এবং বাঁ হাতি স্পিনার আরাফাত সানির দিকে, তখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা সুজনের। খবরটি শুনে ক্ষুব্ধ হেড কোচ হাতুরুসিংহে, সে সময়ের বোলিং কোচ উল্টো প্রশ্ন তুললেন দুই আম্পায়ারের এই সন্দেহ বাতিক নিয়ে! পরবর্তীতে ম্যাচ অফিসিয়ালরা সন্দেহ থেকে করেছেন দু’বোলারকে রিপোর্টেড, তখনো তা মানতে পারেননি এই দুই কোচ! আইসিসি নির্দেশিত চেন্নাইয়ের শ্রীরাম চন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে বায়ো মেকানিক্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন দু’জনই হাসতে হাসতে। ফিরেছেনও হাসতে হাসতে। অথচ, সারা গায়ে সেন্সর লাগিয়ে দেয়া সেই পরীক্ষার রিপোর্টেই কি না দু’জনের বোলিং অ্যাকশনে ধরা পড়লো ত্রæটিÑ দু’জনেই এক সঙ্গে হলেন নিষিদ্ধ! গত ১৯ মার্চ আইসিসি’র ওই নিষেধাজ্ঞাদেশ মেনে নিতে পারেননি মাশরাফি। সুপার টেনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ দলের মনোবলে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে তাসকিন, আরাফাত সানির উপর করা হয়েছে অবিচার। চেন্নাইয়ের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বেঙ্গালুরে সুপার টেনে অবতীর্ণ হওয়ার আগে দুই অপরিহার্য বোলারকে হারিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে পানি। নিজে কেঁেদছেন, কাঁদিয়েছেন পুরো দেশকে মাশরাফি।
আসলেই চেন্নাইয়ের ল্যাবরেটরির পরীক্ষা পদ্ধতিটা যে ছিল ত্রæটিপূর্ণ, তা প্রমাণ করে ছেড়েছে এই দুই বোলার। আম্পায়ার রড টাকার এবং এস রবি’র সন্দেহটা যে ছিল অমূলক, তা প্রমাণে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। লেগেছে মাত্র ৬ মাস। অ্যাকশন সংশোধনে নিজেদের চেষ্টা তো ছিলই, বিসিবি’র বোলিং রিভিউ কমিটিও ছিল সতর্ক। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে খেলা এই দুই বোলারের বোলিংকে চোখে চোখে রেখেছে বিসিবি। বোলিং রিভিউ কমিটির সামনে দিতে হয়েছে তাদের দু’জনকে দিতে হয়েছে পরীক্ষা। টু ডি প্রযুক্তির ক্যামেরায় তাদের বোলিং অ্যাকশনের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তাদেরকে পুনরায় বায়ো মেকানিক্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে ছাড়পত্র দিয়েছে বোলিং রিভিউ কমিটি। গত ৮ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টারে বায়ো মেকানিক্স পরীক্ষায় তাসকিন, আরাফাত সানির বোলিংয়ে ত্রæটির কিছুই পড়েনি ধরাÑ ১৫ দিন পর সেই রিপোর্টটাই আইসিসি’র মাধ্যমে জেনেছে বিসিবি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বোলিংয়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে গতকাল আইসিসি। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তা আইসিসি। যে অপবাদ নিয়ে মনোকষ্টে কেঁটেছে ৬ মাস, সে অপবাদ ঘুঁচেছে তাসকিন, আরাফাত সানির। তবে তাসকিনের পরিবার ছেলের অপবাদ থেকে মুক্তির সংবাদ পেলেও কষ্ট নিয়েই সারাজীবনের জন্য চলে গেছেন আরাফাত সানির বাবা। একসঙ্গে সন্দেহের তীরে বিদ্ধ হয়েছেন, আবার ফিরেছেন তারা দু’জন এক সঙ্গেই। তবে দ্বিতীয়বার আইসিসি নির্দেশিত ল্যাবরেটরিতে বোলিং পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের এটাই প্রথম নয়। এর আগে বাঁ হাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাক এবং অফ স্পিনার সোহাগ গাজীকেও দ্বিতীয়বার বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
বোলিং নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরবেন তাসকিন, এ বিশ্বাস থেকেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দল ঘোষণায় বিলম্ব করেছে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটি। ব্রিসবেনের পরীক্ষাগারে বোলিং পরীক্ষার রিপোর্ট দু’সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবার কথা বলে গতকাল দুপুর পর্যন্ত তাসকিনের রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। হোম সিরিজে ১৪ জনের পরিবর্তে গতপরশু ১৩ সদস্যের দল ঘোষণার কারণও তা। বোলিং নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তাসকিনকে যুক্ত করা হচ্ছে স্কোয়াডে। তবে ২০ জনের পুলে না রাখায় মুক্ত আরাফাত সানিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে করতে হবে অপেক্ষা। আপাতত: তার ঠিকানা জাতীয় লীগ।
ব্রিসবেনের পরীক্ষায় উতরে আইসিসি’র নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় মুক্তির আনন্দে অন্য এক ভাললাগা অনুভূতি প্রকাশ করেছেন নুতন বলে ১৪৮ কিলোমিটার গতিতে বোলিংয়ে দক্ষ তাসকিন আহমেদÑ ‘রাস্তায় বেরুলে যখন শুনতে হতো আপনি কি খেলতে পারবেন, আপনার হাত কি সোজা হবে? তখন খুব খারাপ লাগতো। এখন আর এ ধরনের প্রশ্ন শুনতে হবে না। আমি আসলেই ভাগ্যবান, কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে যতোদিন ছিলাম ততোদিন বাংলাদেশ কোন আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেনি। অর্থাৎ আমাকে সিরিজ মিস করতে হয়নি। এখন লক্ষ্য একটাই, আগের চেয়েও বেটার বোলিং।’
ঢাকা মেট্রোর হয়ে ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে আগামীকাল খেলতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন যখন, তখন সুসংবাদটি শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন বাঁ হাতি স্পিনার আরাফাত সানিÑ ‘অবশ্যই, ভালো লাগার মতোই খবর পেলাম। পরীক্ষার পর থেকেই টেনশনে ছিলাম পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বোলিং অ্যাকশনে পরিবর্তন আনতে পেরেছি, তাতে বড় একটা ঝামেলা থেকে বাঁচলাম। এখন খুব শান্তি লাগছে। এ যেন মুক্তির আনন্দ।’
এমন খবরে দারুণ খুশি টীম ম্যানেজার খালেদ মেহমুদ সুজনÑ ‘দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। তাই তাদের বোলিংয়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য খুশির খবর।’ যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই দুই বোলারের বোলিংয়ে তীক্ষè নজর রাখতে হয়েছে, দ্বিতীয়বার পরীক্ষাগারে পাঠানোর আগে থাকতে হয়েছে সতর্ক, সেই বোলিং রিভিউ কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস নিজেও ফেলেছেন স্বস্তির নিঃশ্বাসÑ ‘আমরা তাসকিন ও সানিকে শুরুতেই রিভিউ কমিটির মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা যখন আমাদের ‘টুডি’ ক্যামেরার সামনে পরীক্ষা দিয়েছিল, তখনই বোঝা যাচ্ছিল এবারের পরীক্ষায় ইতিবাচক রেজাল্ট আসবে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন