উজানের ঢলে দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী, শাখানদী, উপ-নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠছে। কোথাও কোথাও পানি অপরিবর্তিত বা থমকে আছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল, সিকিম, গাঙ্গেয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ এবং মধ্য-ভারত, নেপাল ও তিব্বতসহ চীনে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরেও হচ্ছে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ। বর্ষার বাহক মৌসুমী বায়ু এ অঞ্চলে সক্রিয়। উত্তর বঙ্গোপসাগরেও সক্রিয় রয়েছে। আসছে প্রচুর জলীয়বাষ্প ও মেঘমালা। মৌসুমী বায়ু আরও জোরদার হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এর সক্রিয় প্রভাবে বিস্তীর্ণ এ অঞ্চলে পুরোদমে জেঁকে বসেছে বর্ষা।
অতিবৃষ্টিতে প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রধানত ভারতে উজানের অববাহিকায় পানি বেড়ে গিয়ে বাংলাদেশে ভাটিতে নেমে আসছে ঢল-বান। এরফলে উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকায় এবং পদ্মা-মেঘনা হয়ে ভাটির শেষ প্রান্তে চাঁদপুর-নোয়াখালী অবধি বাড়ছে পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী দশ দিনের পূর্বাভাসে জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে আসছে সপ্তাহে (১২ জুলাই নাগাদ) উভয় প্রধান দুই নদ-নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, দেশের প্রধান নদ-নদীর ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল বুধবার ৬৪টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৯টিতে হ্রাস পায়। ৫টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। মঙ্গলবার নদ-নদীসমূহের ৫৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৫১টিতে হ্রাস পায়। সোমবার ৬০টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৯টিতে হ্রাস পায়। রোববার ৫৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৮টিতে হ্রাস পায়। শনিবার ৪৪টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৫৫টি স্থানে হ্রাস পায়। শুক্রবার ৬৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৭ স্থানে হ্রাস পায়। আপাতত কোন নদীর প্রবাহ বিপদসীমায় পৌঁছায়নি। তবে বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নদ-নদীসমূহের প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদে পানি স্থিতিশীল রয়েছে। অন্যদিকে যমুনা নদে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উভয় নদে পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল বা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। কুশিয়ারা ব্যতীত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকায় নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্য উল্লেখ করে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্বাভাসে জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ সময়ে উত্তরাঞ্চলে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
দশ দিনের পূর্বাভাস
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী ১০ দিনের অন্তবর্তী পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানির সমতল আগামী ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থিতিশীল থেকে এরপর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ৭ দিনে আপাতত ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা নেই। তবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১২ জুলাই নাগাদ বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং চরাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হতে পারে।
গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সমতল স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ৭ দিনে আপাতত গঙ্গা নদীর অববাহিকায় বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা নেই। তবে পদ্মা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে ১২ জুলাই নাগাদ রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকার চারপাশের নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে ঢাকার চারপাশের নদীসমূহের এই অববাহিকায় বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা নেই।
নদ-নদী প্রবাহ পরিস্থিতি
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহ পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্তে জানায়, উত্তর জনপদের তিস্তা নদী ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার যথাক্রমে ৩৫ এবং ৫৮ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। ধরলা নদী কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৭৫ সে.মি. নিচে প্রবাহিত হচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্র নদ চিলমারী পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৫৮ সে.মি. নিচে রয়েছে। যমুনা নদ সাঘাটা, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি ও ফুলছড়িতে পানি কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার যথাক্রমে ৫০, ৬১, ৬৩ ও ৭০ সে.মি. নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা সুরেশ^র পয়েন্টে ৬১ ও গোয়ালন্দে ৬২ সে.মি. নিচে রয়েছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আপার মেঘনা অববাহিকায় সুরমা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে সুনামগঞ্জে বিপদসীমার ২৭ সে.মি. নিচে রয়েছে। কলমাকান্দায় সোমেশ^রী নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৮ সে.মি. নিচে অবস্থান করছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য অববাহিকায় মুহুরী, হালদা ও সাঙ্গু নদীর পানি আবারো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারী বর্ষণ অব্যাহত
উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় ত্রিপুরার আগরতলায় ৮৪, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৬৮ মিলিমিটারসহ বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে গত ২৪ ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে লরেলগড়ে ২৭৫, মহেশখোলায় ২৪৮, সিলেটে ১৫৫, সুনামগঞ্জে ১৫০, দুর্গাপুরে ৯৬, মৌলভীবাজারে ৯৪, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৮৭, ছাতকে ৭৫, ময়মনসিংহ ও জারিয়াজঞ্জাইলে ৭৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭০, জকিগঞ্জে ৬০, কক্সবাজারে ৫৮, পরশুরামে ৫৬, শেওলায় ৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পাউবো।
এদিকে আবহাওয়া বিভাগ ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তায় জানায়, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন