শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ঘর ভেঙে স্বপ্ন চুরমার

প্রধানমন্ত্রীর উপহারেই অনিয়ম দুর্নীতি মুই এই ঘর চাই না, এই ঘরে থাকলে মরণও অইতে পারে : উপকারভোগী ঊর্মিলা রানী অনেক স্থানে ব্যক্তিমালিকানার জমি খাস দেখিয়ে ঘর নির্মাণের অভিযোগ

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

‘এতদিন মুই মাইনসের জাগায় থাকতাম, নিজের জায়গা আছিল না, শেখ হাসিনা আমার মতো মানুষরে ঘর দ্যাছে’ অহন মুই খুব খুশি, মুই অহন নতুন কইরা বাঁচার আশা পাইছি। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে এভাবেই নিজের আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন বরগুনার আমতলী উপজেলার বিধবা ঊর্মিলা রাণী। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি এখন বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোরে একখান ঘর দ্যাছে। ঘরহান দুইফির ভাইঙ্গা গ্যাছে। এই ঘরের নিচে চাপা পইড়া মোর জানডাও যাইতে পারে। মুই এই ঘর চাই না। এই ঘরে থাকলে মোর মরণও অইতে পারে।

বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণই তার একমাত্র লক্ষ্য। দেশের একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না, একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না এটাই প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া। সে লক্ষ্যে এবার মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন-গৃহহীনদের প্রধানমন্ত্রী ঘর উপহার দিয়েছেন। গৃহ ও ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর একটি নজীরবিহীন মানবিক উদ্যোগ। তবে দুর্নীতিবাজ চাটুকারদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও নির্মাণে গাফিলতির কারণে প্রধানমন্ত্রীর সে চাওয়া ব্যর্থ হতে চলেছে। গৃহহীনদের দেয়া প্রধানমন্ত্রী উপহারের ঘর বিভিন্ন স্থানে ভেঙে পড়েছে, কয়েকটিতে দেখা দিয়েছে ফাটল। যেনতেনভাবে নিম্নমানের মালামাল দিয়ে এইসব ঘর নির্মাণ করে সংশ্লিষ্টরা প্রধানমন্ত্রীর এমন মহৎ উদ্যোগকে কালিমালিপ্ত করেছে। সেই সাথে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ঘর পাওয়া মানুষদের বুকভরা স্বপ্ন-আশা। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে যাদের চোখে আনন্দের বন্যা নেমে ছিল, সে ঘর ভেঙে পড়ায় তারাই এখন দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে সারা দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করে তাদের জমিসহ ঘর উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহ ও ভূমিহীন থাকবে না’ বঙ্গবন্ধুকন্যার এই ঘোষণা বাস্তবায়নে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ২ শতাংশ জমির সঙ্গে ঘর পেয়েছেন ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৬০টি পরিবার। এই প্রকল্পের ঘরগুলো সরকারি খাস জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটির আয়তন ৪০০ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে আছে দুটি কামরা, রান্নাঘর, বারান্দা ও টয়লেট। এছাড়া ১০টি ঘরের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। সেমিপাকা এই ঘরগুলোর প্রতিটি তৈরি করতে প্রথম পর্যায়ে খরচ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে খরচ হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পর্যায়ে দুই লাখ টাকা।

তবে বর্ষার শুরুতেই কয়েকটি স্থানে ভূমি ধসে ঘর ভেঙে পড়ায়, কয়েকটি ঘরে ফাটল দেখা দেয়ায় নির্মাণের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সাথে অনিয়ম-দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। অনেক উপজেলায় ব্যক্তিমালিকানা জমি খাস জমি দেখিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ থাকার পরেও উপজেলা প্রশাসন তা আমলে নেয়নি। এপর্যন্ত ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের, বগুড়ার শেরপুরের, মুন্সীগঞ্জ সদরের, বরগুনার আমতলীতে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অন্তত পাঁচজনকে ওএসডি করা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে। আরও অনেক কর্মকর্তাও শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীর একান্ত চাওয়াপূরণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেটাকে একেবারে ইবাদত হিসেবে নিয়েছেন, সেটাতে যখন ব্যর্থ হই তখনতো তা আমাদের ব্যর্থতা এবং লজ্জার বিষয়।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলার ১০ উপজেলায় নির্মিত ও নির্মাণাধীন ঘরগুলোর নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণে ৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জসীম উদ্দীন হায়দার ৮ জুলাই ওই ৫ কমিটি গঠন করেছেন। কমিটিগুলোকে ৭ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। জলার মেহেন্দিগঞ্জ ও বানারীপাড়া উপজেলায় নির্মাণাধীন ঘরের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের প্রধান করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. শহিদুল ইসলামকে। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রশান্ত কুমার দাস, বরিশাল সদর ও উজিরপুর উপজেলার জন্য গঠিত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গৌতম বাড়ৈ, হিজলা ও মুলাদী উপজেলা কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রকিবুর রহমান খান এবং বাকেরগঞ্জ ও বাবুগঞ্জ কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. সোহেল মারুফ।

বরগুনা সংবাদদাতা জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে বরগুনাতে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিশেষ উপহারের বেশিরভাগ ঘর নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। পরিমাণের চেয়ে কম ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে এসব ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করে উপকারভোগীর কাছে হস্তান্তর করার আগেই ভেঙে পড়ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারের কারণে ভেঙে পড়ছে এসব বসতঘর। কাজের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার বলছেন, স্থানীয়রা ঘর ধরে নাড়াচাড়া করায় এসব পাকাঘর ভেঙে পড়ছে।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধীনে বরগুনা জেলায় এক হাজার ৭শ’ ৩০টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা বাজেট ধরে ৪৫ ব্যাগ সিমেন্ট ও সাড়ে ৬ হাজার ইট দিয়ে একেকটি ঘর তৈরি করার কথা থাকলেও ঘর প্রতি ইট দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার। সিমেন্ট দেয়া হয়েছে ৪৫ ব্যাগের পরিবর্তে ৩০ ব্যাগ। এই কারণেই উপজেলার সব ঘরই এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীসহ এলাকাবাসী।

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের এরকম বেশকিছু অনিয়মের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেছে। ইতোমধ্যে বরগুনার আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসাদুজ্জামানকে ওএসডি করেছে সরকার।
বরগুনার তালতলী উপজেলার কড়াইবাড়িয়া ইউনিয়নের বেহেলা গ্রামের স্বামী পরিত্যক্ত ৭১ বছর বয়সী উর্মিলা রাণী প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর গত ২৩ জানুয়ারি বরাদ্দ পান। ঘর নির্মাণ শেষে উদ্বোধনের ১২ দিনের মাথায় তার বসতঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ে। দেয়াল ভাঙার একদিন পরই উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে আবার নতুন করে উঠিয়ে দেয়া হয় উর্মিলার ঘর। বরগুনায় তালতলী উপজেলার কড়াইবাড়িয়া ইউনিয়নে বেহেলায় প্রকল্পের বিভিন্ন ঘরের দেয়াল ও মেঝে থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে, সামান্য বৃষ্টিতেই টিনের চালার বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি পড়ে, বিছানাপত্র সব ভিজে যায়, ঘরের ভিতরে পানি জমে, জানালা-দরজা সব নড়বড়ে বলেও জানিয়েছেন এলাকার ভুক্তভোগীরা।

উপকারভোগী ঊর্মিলা রাণী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোরে একখান ঘর দ্যাছে। ঘরহান দুইফির ভাইঙ্গা গ্যাছে। এই ঘরের নিচে চাপা পইড়া মোর জানডাও যাইতে পারে। মুই এই ঘর চাই না। এ ঘরে থাকলে মরণও অইতে পারে। ঘরের মালামাল আনার সময় মোর কাছ দিয়া ভাড়া বাবদ ৯ হাজার টাহাও নিছে ওরা। উর্মিলা রানীর প্রতিবেশী সঞ্জয় সরকার, মিতু রানী ও অলোক শীল বলেন, ‘উর্মিলা রানীকে প্রধামন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। যেনতেনভাবে নিম্নমানের মালামাল দিয়ে এই ঘরের কাজ করে প্রধানমন্ত্রীর এমহৎ উদ্যোগকে কালিমাযুক্ত করা হয়েছে।

রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, দূর্গাপুর উপজলোর পালি দক্ষিণপাড়া গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্প নিচু জমিতে করায় সামান্য বৃষ্টির পানিতেই ডুবেছে। চারিদিকে হাঁটু পানি। পানি মাড়িয়েই যাতায়াত করছেন বাসিন্দারা। বর্ষা মৌসুমে এখন এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কাজ করে দিনশেষে ঘরে ফিরতে ভোগান্তির শেষ নেই।

মধুখালি আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার একাধিক ব্যক্তি বলেন, আমাদেরকে ঘরের মালিকানা বুঝিয়ে দেয়া হলেও এখানে নির্মাণ কাজ পুরোপুরি হয়নি। তার মধ্যে মাটি ভরাট ও পায়খানা নির্মাণ কাজও শেষ করেনি। তার মধ্যে আমরা বসবাস শুরু করার আগেই বেশিরভাগ ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। মনে হয় বর্ষার পানি বেড়ে গেলে ঘরগুলো ভেঙে পড়তে পারে।
মুন্সীগঞ্জ থেকে মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় জেলার প্রতিটি উপজেলায় ভূমি ও গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ সদর, গজারিয়া এবং লৌহজেং প্রকল্পের নির্মাণকাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। জায়গা নির্বাচনের ত্রুটিতে ভূমি ধস এবং নিম্মমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় নির্মাণাধীন ঘরের অবকাঠামোর স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে সদর উপজেলার প্রকল্প সংশিষ্ট ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্বে দায়িত্বহীনতা, অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্ত টিম মাঠপর্যায়ে তদন্তকাজ শুরু করেছে।

নোয়াখালী ব্যুরো জানায়, মুজিববর্ষে গৃহহীন পরিবারের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় নোয়াখালীর ৯টি উপজেলায় ১২৮৬টি একক ঘর প্রদান করা হয়। এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১৫০টি ঘর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। অবশিষ্ট ঘরের মধ্যে ৮৩৫টি ঘর দ্বিতীয় পর্যায়ে উপকারভোগী পরিবারের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখানে এখনো কোনো অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা সংবাদদাতা আব্দুস সালাম জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ইতি মধ্যে আশ্রয়হীন ১৮৫টি পরিবারকে তাদের কাক্সিক্ষত স্বপ্নের ঘর বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকি ৮০টি ঘরের কাজ চলমান আছে। কিন্তু আশ্রয়হীনদের স্থায়ী ঠিকানায় স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন মলিন হতে বসেছে। ইতি পূর্বে যারা ঘর পেয়েছেন তারা আতঙ্কে দিন রাত কাটাচ্ছেন। কারণ বসবাস শুরু করার আগেই ভেঙে যাচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের এসব ঘর। নরম মাটিতে, মানহীন কাঁচামাল দিয়ে তৈরি ঘর ইতিমধ্যেই ফাটল ধরে ভেঙে যাচ্ছে, দেভে যাচ্ছে ঘরের ফ্লোর। পরিকল্পনাহীন নিচু স্থানে ঘর নির্মাণ করায় অল্প ঝড় বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন মানহীন ঘর তালা দিয়ে অনেকেই অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী আমরা আশ্রয়হীনদের জন্য ঘর দিয়েছেন। কিন্তু ঘরের বরাদ্ধকৃত টাকা দুর্নীতিবাজরা গ্রাস করেছে। আমরা এদের বিচার চাই।

বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমি ও গৃহহীনদের দেয়া বাড়িগুলো নির্মাণে নানামুখি আনিয়ম দুর্নীতি ও গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যেই সরকার শেরপুর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী সেখ এবং শাজাহানপুর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা পারভীনকে ওএসডি করা হয়েছে।
অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের জন্য গঠিত টিম বগুড়ার কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত শেষে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব ও আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, এধরনের অগ্রাধিকার ও জনগুরুত্ব সম্পন্ন প্রকল্পে কোনো অনিয়ম গাফিলতি ও দুর্র্নীতি হয়ে থাকলে তা’ সহ্য করা হবে না। তিনি আরো বলেন, দেখতে হবে গৃহনির্মাণে নক্সাগত ত্রুটি হয়েছে কি না, আর্থিক অনিয়ম হয়েছে কি না? ফাটল, ধস এর জন্য প্রাকৃতিক (বর্ষণ) দায়ী কি না ?

কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পের গৃহ নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গৃহহীন মানুষের ঘর নির্মাণের জন্য অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠ, ইট, বালু, সিমেন্ট, রড, টিন ব্যবহার করা হচ্ছে। সুবিধাভোগীদের আশঙ্কা উন্নত মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার না করা হলে যে কোনো মুহূর্তে ধসে যাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার সীমান্তবর্তী আনন্দপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫৭টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে ঘরগুলোতে নিম্নমানের ইট খোয়া, রড ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিকাদার আগামী মাস দেড়েক পরে সুবিধাভোগীদের হাতে হস্তান্তর করতে পারবেন। তবে স্থানীয় ও সুবিধাভোগীরা এত নিম্নমানের সামগ্রীর ঘর নির্মাণ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

কুড়িগ্রাম চিলমারী সংবাদদাতা ফয়সাল হক জানান, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারেরর ঘর ‘শান্তির নীড়’ এ শতশত মানুষ মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছে। কিন্তু সেই শান্তির নীড় মৃত্যু ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আশ্রয় নেয়া মানুষজনের। বৃষ্টির সাথে ধসে পড়তে শুরু করেছে চরফেসকা বাবদ হাতিয়া বকসী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যাক, ধসে যাচ্ছে ওয়াল ভেঙে যাচ্ছে ঘর। আশ্রয় হারিয়ে সদ্য আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো দিশাহারা। গত বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন স্থানে স্থানে মাটি ধসে গেছে এবং ধসে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যারাক। এসময় কথা হলে বৃদ্ধা সাহিদা (৫৫) বলেন বহে কি আর কমু নদী সউগে ভাঙ্গি নিচে আছিনু বান্দের রাস্তাত (বাঁধে) সেটাও ভাঙ্গি দিছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মানুষ, পরে আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় পাইছোং। মনে বড় সুখ পাছিনু কিন্তু সেই সুখ উড়ে গেইছে, এই ঘরত (ঘরে) থাকতে ভয় হয় খালি মনে হয় কখন যেন ভাঙ্গি যায়, কন না বাহে ঘরের যে অবস্থা জীবন হামার যেন কচুর পাতায় পানির মতো হবার নাগছে, (কচুর পাতার পানি এই বুজি পড়ে তেমন হইছে) আর মনে হয় কখন জানি ভাঙ্গি পড়ে এই বুঝি জীবন হারাই।

ধামরাই উপজেলা সংবাদদাতা মো. আনিস উর রহমান স্বপন জানান, মুজিব বর্ষের উপহার হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আধাপাকা ঘরগুলো গৃহহীনদের মাঝে হস্তান্তরের আগেই খুলে পড়তে শুরু করেছে ঘরের দরজা ও জানালা। শুধু কি তাই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি দরজা ও জানলার পাল্লাগুলিতে ছিদ্র রয়েছে। বিতরণে ও অনিয়মের রয়েছে অভিযোগ। উপজেলার সোমভাগ ইউনিয়নের দেপাশাই মৌজায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ফেজ-১ এর ৩৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এরমধ্যে ২৮টি ঘর কাগজ কলমে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে ৭/৮টি পরিবার বসবাস করছে। অন্যরা ঘর বুঝে পাওয়ার পরপরই ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছে। প্রশাসনের লোক আসবে এমন সংবাদ পেলেই তারা আবার ঘরে উঠবে এমন তথ্যও রয়েছে।

চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি উপজেলা সংবাদদাতা সৈয়দ জাহেদুল্লাহ কুরাইশী জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গায় গৃহ ও ভূমিহীন পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দেয়া ঘর ভেঙে যাওয়া কিংবা ফাটল ধরার ঘটনায় এবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান ফটিকছড়িতে দু’টি আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন। গতকাল পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহ ও ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প একটি নজীরবিহীন মানবিক উদ্যোগ। শত-সহস্র নির্মিত ঘরের মধ্যে ১ শতাংশ হয়তো নানা কারণে নষ্ট হতে পারে। তবে ৯৯ শতাংশ ঘরে কোনো সমস্যা দেখছি না।

মানিকগঞ্জ সাটুরিয়া থেকে মো: সোহেল রানা খান জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেয়া অধিকাংশ ঘরে থাকছে না বরাদ্দপ্রাপ্তরা। আবার ৬ মাস না যেতেই কয়েকটি ঘরের মেঝে ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে, কোনো কোনো ঘরে বৃষ্টি হলে ভেতরে পানি পড়ে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের পর ঘরগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে উপকারভোগীদের মাঝে। গতকাল সরেজমিনে বরাঈদ ইউনিয়নের আগ সাভার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘরে থাকছে না বরাদ্দপ্রাপ্তরা। ১৭টি ঘরের বেশিরভাগ ঘরে তালা ঝুলছে। নির্মাণ করা কয়েকটি ঘরের দেয়াল ও মেঝে ফাটল ধরেছে। আশ্রয়ণে বরাদ্দ পাওয়া আরেকটি ঘরে থাকা আন্না রাণী কর্মকার জানায়, তাদের ঘরে বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। বৃষ্টির সময় ঘরে ঘুমানোর স্থানে বালতি বসিয়ে রাখতে হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Murthi ১১ জুলাই, ২০২১, ৮:১২ এএম says : 0
Egulo gorib manush marar fondi Karon desh Noito antorjatik ongone Singapore hoise Kemne bole. Gorib more Dhoni thakle Singapore hoise Bola easy hoi.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন