আত্মরক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং যেকোনো অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করা মানুষের জন্মগত ও নৈতিক অধিকার। এ অধিকার সাংবিধানিক অধিকারেও পরিণত হয়েছে। মানুষ এক প্রকার প্রাণী। মানুষ ছাড়াও প্রতিটি প্রাণীকে সৃষ্টিকর্তা শারীরিক গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘আত্মরক্ষার’ কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। কাউকে ‘দ্রুতগতি’ দিয়ে তার আত্মরক্ষার সুযোগ দিয়েছেন, কেউ নিজেকে আত্মরক্ষা করে দাঁতে সুরক্ষিত বিষ দিয়ে, কেউ আত্মরক্ষা করে নিজ শুঁড় দিয়ে, কেউ বা ধারালো নখের মাধ্যমে।
বিভিন্ন প্রাণী শারীরিক অঙ্গপ্রতঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমেই নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়াস পায় এবং সেই অঙ্গ দিয়ে অন্যকে আক্রমণ করে। আত্মরক্ষা ও আক্রমণ পাশাপাশি অবস্থান করলেও স্থান, কাল, পাত্রভেদে এর ব্যবহার হয় ভিন্নতর। মানুষের বেলায় একই প্রক্রিয়া থাকলেও মানুষকে দেয়া হয়েছে বিচার-বুদ্ধি এবং সে বিচার বুদ্ধি কোথাও প্রয়োগ হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় অপপ্রয়োগ। এ অপপ্রয়োগের মাধ্যমেই পৃথিবী ও সভ্যতা আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। যার অস্ত্রের বল রয়েছে তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে তার প্রতিপক্ষ। সবাই মুখে মুখে মানবতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু কেউ তার প্রতিপক্ষকে সহ্য করতে পারে না। এ অবস্থা চলছে এখন টপ টু বটম।
গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান হলো অন্যের সমালোচনাকে সহ্য করা এবং যুক্তিসঙ্গত হলে তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া। এ ছাড়াও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী করে। এর কোনোটাই এখন অনেক দেশে দেখা যায় না। সহাবস্থানের পরিবর্তে শুরু হয়েছে ‘আক্রমণের’ সংস্কৃতি। নিজেকে আত্মরক্ষা করা এখন শুধু মৌলিক অধিকার নয়, বরং এটি এখন একটি আইনগত অধিকার বটে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবলের কাছে দুর্বলের কোনো অধিকারই বাস্তবে রূপ লাভ করে না। পৃথিবীতে এখন সব আইনের ঊর্ধ্বে আইন হলো, জোর যার মুল্লুক তার। যার বাহুবল, অস্ত্রের বল, ক্ষমতার বল ও অর্থের বল রয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো রয়েছে তার কাছে বিবেক ও মানবতা কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখে না বা রাখতে পারে না।
এক শ্রেণীর মানুষের জন্য এ পৃথিবীটা একটি স্বর্গরাজ্য। তবে বেশির ভাগ মানুষ, যাদের হাতে অস্ত্র, টাকা, ক্ষমতা বা ক্ষমতাসীনদের ছায়া নেই তাদের জন্য এ সমাজ এবং এ পৃথিবী নরকের সমতুল্য। একসময় মানুষ হিংস্র্র পশুর সাথে যুদ্ধ করে বনে-জঙ্গলে বসবাস করত। আদি যুগে পাথরে পাথরে ঘর্ষণ করে মানুষ আগুন জ্বালাতো। লতাপাতা জড়িয়ে জীবন ধারণ করত। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ায় এবং সভ্যতার পর্যায়ক্রমে অগ্রগতির কারণে সৌভাগ্যবান মানুষেরা স্বর্গরাজ্যে বসবাস করছে। এখন মানুষকে বন্যজন্তু বাঘ-ভাল্লুুকের সাথে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় না। এখন মানুষকে বাঁচতে হয় মানুষের সাথে যুদ্ধ করে। একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন আরেকজন মানুষ, যদি সে নিজে দুর্বল ও অসহায় হয়।
পৃথিবীব্যাপী অনেক মানবাধিকার সংস্থা গড়ে উঠেছে। সংস্থাগুলো প্রতিনিয়তই অমানবিক ঘটনাবলির তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করছে। বাংলাদেশেও অনেক মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। তারাও প্রতিবেদন প্রতি বছরই দাখিল করে আসছে। অথচ ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। স্বার্থন্বেষী মহল ও ক্ষমতাসীনরা প্রতিবেদনগুলো টিস্যু পেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেয়, কার্যকর কোনো ভূমিকা গ্রহণ করে না। এর পেছনের কারণ কারো অজানা নয়।
পৃথিবীতে এখন কোনো কিছুর অভাব নেই, অভাব রয়েছে শুধু নৈতিকতার। মানুষের কল্যাণের জন্য নিত্য নতুন আইন করা হচ্ছে, কিন্তু সে আইন প্রয়োগ হচ্ছে অনৈতিকভাবে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নিত্য নতুন জটিল জটিল আইন তৈরির একটি ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়েছে এবং সব আইনই প্রয়োগ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যম। এর অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে নৈতিকতাবিরোধী অনেক কর্মকান্ডের অভিযোগ ছাড়াও ক্ষমতাসীনদের তাঁবেদারিসহ আইন অপপ্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। নৈতিকতা মানবিক গুণাবলির অন্যতম উপাদান। মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে উদ্বুুদ্ধ করে নৈতিকতা। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক বিদ্বান ব্যক্তিও সমাজবিরোধী কর্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে, যা একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষের কাছ থেকে কল্পনাও করা যায় না। এর পেছনের কারণ হলো, নৈতিকতা। একজন অপরাধী র্ঘণ্য অপরাধ করার সময় যদি তার নৈতিকতা প্রভাববিস্তার করে তখন সে ওই অপরাধ করতে পারে না, বরং আপন মন থেকেই প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়। নৈতিকতা কোনো উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় না, যদি না নিজের মন থেকে তা উপলব্ধি হয়। তবে শিক্ষা, পারিবারিক আচার-আচরণ এবং আশপাশের মানুষ অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক অবস্থান থেকে নৈতিকতার প্রভাব সৃষ্টি হয়। নৈতিকতার প্রধান উৎপত্তিস্থল হলো মানুষের বিবেক। বিবেকই মানুষকে পশু-প্রাণী থেকে আলাদা করে রাখে।
মানুষ নিজ নৈতিকতা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না। মানুষের একমাত্র চিন্তা স্বার্থ আর স্বার্থ। আত্মীয়তা, দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব প্রভৃতি বিকিয়ে দেয় ‘স্বার্থের’ কারণে। নিজ স্বার্থ হাসিল করে মানুষ ভোগ-বিলাসের জন্য আরো পেতে চায়, যে পাওয়ার কোনো শেষ নেই, কিন্তু সে প্রাপ্তি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। মানুষের জীবন, ক্ষমতা ও সম্পদ সম্পূর্ণভাবে একটি ক্ষণস্থায়ী বিষয় এবং অত্যন্ত ভঙ্গুর। এ উপার্জিত সম্পদ ও ভোগ-বিলাসের জন্য পরকালে তো বটেই, ইহকালেও অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। সম্পদ ও ক্ষমতাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
স¤প্রতি অভাবিত-অস্বাভাবিক ধর্ষণ, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, মা-বাবার সন্তানকে খুন করে নিজেরা আত্মহত্যা করা, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন এবং মা-বাবাকে খুন করে নিজে নিজেই পুলিশকে খবর দেয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষিত বা ছাত্রীকে নিয়ে পালানো আগেও ছিল, তবে ইদানিং বেড়েছে। শিশুধর্ষণও অনেক বেড়ে গেছে। ধর্ষণের ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার ধর্ষককে মৃত্যুদন্ড দেয়ার আইন পাস করেও তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এর পেছনের মূল কারণ নৈতিকতা।
কিশোর গ্যাংয়ের বখাটেপনায় দেশবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়তই কিশোর গ্যাংদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠাচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। কিশোর গ্যাং দিনে দিনে কেন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে, সেটা সরকার তলিয়ে দেখছে না। সরকারের পাঁচমিশালি নীতিই সামাজিক সব বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। সরকার আকাশ-সংস্কৃতির দরজা খুলেছে, হাতে হাতে ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে যৌনচর্চাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কিশোর গ্যাংদের আচার-আচরণ, চুলের স্টাইল, পোশাকের ধরন সব কিছুই বোম্বের সিনেমা থেকে অনুকরণ করা। বাংলাদেশের সিনেমাগুলোতেও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে কিভাবে হিরো সাজা যায়, সে শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে। বাংলা নাটকেও দেখা যায়, মা-বাবাকে অবহেলা, অপমান করে প্রেমিক-প্রেমিকাকে প্রাধান্য দেয়ার ঘটনা। দেশী-বিদেশী আকাশ সংস্কৃতি কিশোর-যুবকদের নৈতিকতার দিকে প্রভাবিত না করে ‘হিরো’ সাজার দিকে প্রভাবান্বিত করছে।
অন্য দিকে এ হিরোদের শায়েস্তা করার জন্য জনগণের কাছে মুখরক্ষার জন্য সরকার কঠিন কঠিন আইন প্রণয়ন করছে বটে, কিন্তু আশানুরূপ কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁয় ডিজে পার্টি হচ্ছে, যা সংস্কৃতির নামে সভ্যতার একটি কলঙ্ক এবং এগুলো নৈতিকতার পরিবর্তে যুবসমাজকে অধঃপতনের দিকে ধাবিত করছে।
প্রখ্যাত অপরাধবিজ্ঞানী Gibbons এবং Garabedian তাদের প্রণীত The Criminologist: Crime and the Criminal বইতে একজন অপরাধীকে নৈতিকভাবে অপরিপক্ব-অপরিণত (Morally defective) বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীদ্বয় এ কথাও বলেছেন- সম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ অপরাধী হয়। সার্বিক পর্যালোচনায় এ কথাই বলতে হয়, মানুষ এবং অমানুষের মধ্যে তারতম্যের মাপকাঠি হলো নৈতিকতা। কিন্তু সম্পদ, ক্ষমতা ও উচ্চ মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাসহ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যখনই কোনো মানুষ নৈতিকতা বোধ হারিয়ে ফেলে তখনই তার মানবিক গুণাবলি বিলোপ হয়। ফলে যেকোনো অপরাধ করতেও সে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। সভ্যতা ও সমাজকে তখন তুচ্ছ মনে করে নিজ স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন