দেশের বেহাল সড়কের বিড়ম্বনা যেন নিত্যসঙ্গী। একদিকে নতুন রাস্তা তৈরি বা সংস্কার হয়, তো অন্যদিকে পিচ উঠে যায় রাস্তার। অথচ দেশের সড়ক মহাসড়কের উন্নয়নে সরকার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে। ব্যয়বহুল সড়ক বানালেও সেগুলো টিকসই হচ্ছে না বেশিদিন। প্রতিবছরই হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয় সড়ক সংস্কারে। কাজ শেষ হওয়ার আগেই ফুলে-ফেঁপে গেছে যশোর-খুলনা মহাসড়ক। রাস্তাটির বেজকোর্স নির্মাণে প্রয়োজনীয় মানদন্ড অনুসরণ করা হয়নি। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও এখন একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে চালু হওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও অনেক স্থানে দেখা যায় রাস্তা হয় ফুলে উঠেছে, নয়তো দেবে গিয়েছে। এসব মহাসড়কের প্রতিটিতেই নিম্নমানের নির্মাণ কাজের অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণের মান নিয়েও। দেশের মহাসড়কগুলো এখন ফুলে ওঠা বা দেবে যাওয়ার বিষয়টি এখন সাধারণ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলা সড়ক থেকে জাতীয় সড়ক সবখানেই একই সমস্যা। সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের দাবি, ওভারলোডিংয়ের কারণে সড়ক-মহাসড়কে এই সমস্যাটি দেখা দিচ্ছে।
তবে সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক ভেঙে খানাখন্দ হওয়ার মূলে মানহীন বিটুমিন। সঙ্গে আছে নির্মাণ ত্রুটি এবং ওভারলোডিংসহ আরো কিছু সমস্যা। তাদের মতে, খারাপ বিটুমিন থেকে প্রথমে দেখা দেয় আন্ডুলেশন সমস্যা। এতে সড়ক উঁচু-নিচু ঢেউয়ের আকৃতি ধারণ করে। পরে পণ্যবাহী গাড়ির চাকায় রাস্তা চৌচির হয়ে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। এই থেকে শুরু হয় ভাঙন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আবহাওয়া বিবেচনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহারে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে তা মানা হচ্ছে না। মানহীন এই বিটুমিনের মাসুল দিতে হচ্ছে বছরের পর বছর। মানহীন বিটুমিনের ব্যবহারে সড়ক দ্রুত ভেঙে যায়। আগের মতো শুধু বর্ষাকাল নয়, বছরের সব ঋতুতেই ভাঙছে সড়ক। খানাখন্দ আর জলাবদ্ধতা বাড়াচ্ছে জনদুর্ভোগ। সড়ক মেরামতে অপচয় হচ্ছে সরকারের অর্থের। কিন্তু এ ধরনের নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ঠেকানোও যাচ্ছে না।
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বর্ষাকালের সময়সীমায় সামান্য বদল দেখা যায়। বর্তমানে নভেম্বরের শুরু থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। মে-জুন থেকে অক্টোবর অবধি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বৃষ্টিপাতহীন সময়ে সড়ক-মহাসড়কে জরিপ করে সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও যে সড়কে নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়, তার একটি সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে এই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, দেশের মোট সড়ক-মহাসড়কের প্রায় ১৬ শতাংশ ভাঙাচোরা। অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার পাঁচ কিলোমিটার সড়কে নানা রকম ভাঙন রয়েছে। এর মধ্যে ৬৯১ কিলোমিটার সড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় মহাসড়কের ৪৮৭ কিলোমিটার অংশের বেহাল অবস্থা। এরমধ্যে ১৩২ কিলোমিটারের অবস্থা এত খারাপ যে যান চলাচলেরও অনুপযোগী। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের তুলনায় জেলা সড়কের অবস্থা বেশি খারাপ। এ ধরনের সড়কের দৈর্ঘ্য দুই হাজার ২৭ কিলোমিটার।
সরেজমিন দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় শত শত সড়কের বিভিন্ন জায়গা দেবে গেছে কিংবা খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। এসব রাস্তা তৈরির কাজও চলছে। খোলা ড্রামে, পুরনো আমলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, আগুনে পুড়িয়ে গলানো হচ্ছে বিটুমিন। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটুমিনকে গরম করার আদর্শ তাপমাত্রা হলো সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এখানে আদর্শ তো দূরে থাক, তাপমাত্রা মাপারই ব্যবস্থা নেই। আর বিটুমিনের ব ড্রামে চোখ রাখলে দেখা যায়, সবই বেসরকারিভাবে আমদানি করা নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন। তবে কিছু অসাধু ঠিকাদার একটি কৌশল ব্যবহার করে। তারা দেশে তৈরি ইস্টার্ন রিফাইনারির কয়েকটি ড্রাম প্রকাশ্যে রাখেন। আড়ালে রাখেন কম দামে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন। এসব ভেজাল বিটুমিন দিয়ে তৈরি রাস্তাগুলোর সর্বোচ্চ এক বছর বা তারও কম। ফলে সড়কে চলাচল করতে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। সড়কে সড়কে শত শত দুর্ঘটনায় তরতাজা প্রাণ হয় লাশ। এ নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য হলো, বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া নকল আর নিম্নমানের বিটুমিনের কারণেই বাংলাদেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ রাস্তা নির্মাণের ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিম্নমানের আমদানি নির্ভর বিটুমিন ব্যবহারে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী ক্ষতি হচ্ছে। এক. বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। দুই. টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। তিন. কিছু অসাধু ঠিকাদার আর অসৎ ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে অসৎ আমদানিকারকরা মিলে একটি বিটুমিন সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। যার ফলে দেশের বিপুল অর্থের লোকসান হচ্ছে। পাশাপাশি রাস্তাগুলোও টেকসই হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে টেকসই সড়ক উন্নয়নের স্বার্থে দেশীয় ভালোমানের বিটুমিন ব্যবহারের পাশাপাশি নির্মাণ কাজে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রয়োজন টেকসই নির্মাণ কাজ নিশ্চিত করা।
সড়ক-মহাসড়কে রাটিং প্রতিরোধে বিটুমিনের মান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে জানালেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, আগে আমাদের দেশে পাঁচ টনের ট্রাকই বেশি চলত। যানবাহনের সংখ্যা ও সেগুলোয় ভার বহন দুই-ই কম ছিল। এ কারণে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করলেও সড়কগুলো টিকে যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু ট্রাকের সংখ্যাই বাড়েনি, ওভারলোডিংও বেড়েছে ভয়ঙ্করভাবে। আমাদের রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে, গাড়ির ভার বেড়েছে, যানজট বেড়েছে, কিন্তু এখনো আমরা সেই মান্ধাতা আমলের ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার থেকে বের হতে পারিনি। এখনকার গাড়ির ভার আর নিম্নমানের বিটুমিন বইতে পারছে না। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় শুধু ভালোমানের বিটুমিন ব্যবহার করলেই সড়ক টেকসই হবে না বলে মনে করছেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় বেশি, গরমে আবার কড়া রোদ পড়ে। বৃষ্টি ও রোদ দুটিই বিটুমিনের জন্য খারাপ। দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায় সড়কে পানি জমেও বিটুমিন নষ্ট হয়। যানজটে আটকে থাকা গাড়ির চাপে বিটুমিন নষ্ট হয়। যত ভালো মানের বিটুমিনই ব্যবহার করা হোক কেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও সড়ক ব্যবহার প্রবণতায় তা টেকসই হবে না। এক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প হতে পারে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা। শুধু বিটুমিন নয়, বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণে মাটি-পাথর-বালি-সিমেন্টসহ সবখানেই ছাড় দেয়ার প্রবণতা রয়েছে বলে স্বীকার করলেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী।
সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মাঠপর্যায়ে সেটি নির্মাণ করে ঠিকাদার। এ ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে প্রায়ই নিম্নমানের নির্মাণকাজের অভিযোগ উঠছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে তাদের সক্ষমতা নিয়েও। প্রকৌশলীরা বলছেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলো বাংলাদেশেও ব্যবহার করা হয়। নির্মাণযন্ত্র এক হলেও পার্থক্য সেগুলোর মানে। দেশী ঠিকাদাররা যেসব যন্ত্র ব্যবহার করেন, তার বেশির ভাগই পুরনো ও রিকন্ডিশন্ড। বিদেশি ঠিকাদাররা বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে যেসব নির্মাণযন্ত্র নিয়ে আসেন, কাজ শেষের পর সেগুলো দেশের ঠিকাদারদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দেন। আবার বিদেশ থেকেও সরাসরি রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রও সংগ্রহ করতে দেখা যায় ঠিকাদারদের। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে এসব যন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমে যায়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেন, আমরা উন্নতমানের বিটুমিন ব্যবহার শুরু করেছি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে উন্নত বিটুমিন দিয়ে। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে আমরা কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণও শুরু করেছি। পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রীর মানের দিকেও আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। টেকসই মহাসড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নকশা ও নির্মাণশৈলীতেও আমরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার, তার সবই গ্রহণ করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন