শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

কিসের আশায় বৃষ্টিবন্দি সিরিজ?

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে, তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আষাঢ় কবিতাটি যেন বেমালুম ভুলে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি)! গত বেশ কিছুদিনের ঢাকাসহ সারাদেশের বইছে টানা বর্ষণ। তলিয়ে গেছে রাস্তা-ঘাট, ফসলি জমি, পানিতে টইটুম্বুর বাসা-বাড়ি থেকে হাসপাতাল অব্দি। এরই মধ্যে মাঠে গড়ানোর অপেক্ষায় বহুল আকাক্সিক্ষত বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। আশা-নিরাশার দোল কাটিয়ে এরই মধ্যে ঢাকায় পা রেখেছে অজি শিবির। সিরিজের সূচি অনুযায়ী ৩ আগস্ট শুরু হবে প্রথম ম্যাচ। ৪ তারিখ দ্বিতীয় ম্যাচের পর ৫ আগস্ট বিরতি। ৬ ও ৭ তারিখ আবার দুই ম্যাচের পর ৮ তারিখ বিরতি। ৯ আগস্ট হবে শেষ ম্যাচ। কিন্তু আদৌ সফলভাবে শেষ হবে তো সিরিজ? প্রশ্নটি মোটা দাগে উঠছে ম্যাচের দিনক্ষণের বদৌলতে।
ঋতুচক্রে বাংলাদেশে এখন চলছে বর্ষাকাল, ক্যালেন্ডারের পাতার হিসাবে মধ্য শ্রাবণ। আরো স্পষ্ট করে বললে, আজ দিনটি ষোলই শ্রাবণ। জুলাই মাসের শেষান্তে হলেও ষড়ঋতুর এই দেশে বছরের মে মাস থেকেই বেশ বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে। জুন মাস থেকে প্রায় প্রতিদিনই আকাশ ভেঙে ঝরছে বারি। সেটি থাকবে আগস্ট মাসজুড়েই। সামনেই যে আষাঢ় মাস। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরামের পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের দক্ষিণ এশিয়ায় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হবে বলে ধারণা দিয়েছিল। পূর্বাভাস অনুযায়ী এই জুলাই মাসেই বাংলাদেশে অন্তত দু’টি লঘুচাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যার একটি অন্তত নিম্নচাপে পরিণতির সম্ভাবনাও জানিয়েছিলেন তারা। যেটি চলছে। এই সময়ে টানা কয়েকটি বজ্রপাতসহ ও প্রবল বৃষ্টিপাত হবে। হচ্ছেও। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে সিরিজ চলাকালীন প্রতিদিনই থাকবে বজ্রপাতসহ ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা!
ক্রীড়াঙ্গণে একটি কথা বেশ প্রচলিত- বৃষ্টি আর ক্রিকেট চলে হাতে হাত রেখে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। বিশ্বজুড়েই চলছে মহামারি। করোনা নামক ভাইরাসে থমকে গেছে জনজীবন। ঘটছে প্রাণহানি, স্থবির সকল কর্মকান্ড। অন্যন্য ক্রীড়াঙ্গণের মতো কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে ক্রিকেটেও। আমূলে পাল্টে গেছে বৈশ্বিক আসর থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সফরসূচিও। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও এখনও আছে আতঙ্ক। সেই আতঙ্কের মাঝে ক্রিকেট মাঠে গড়াতে বদল এসেছে নিয়মনীতিতে। অনেক নতুনের ভিড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত শব্দ এখন ‘জৈব সুরক্ষা বলয়’। আসন্ন অস্ট্রেলিয়া সিরিজে যেটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
করোনাকালে আন্তর্জাতিক সিরিজ আয়োজনের অভিজ্ঞতা এখন আর নতুন কিছু নয় বাংলাদেশের কাছে। দুই দলই সিরিজ শুরুর প্রাক্বালে বিদেশ সফর করে আসছে বলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। তারপরও এই সিরিজ আয়োজনের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার অনেক শর্ত মানতে হয়েছে বিসিবিকে। শেষ মুহূর্তে এসেও অজিদের সব চাহিদা পূরণে বদ্ধপরিকর বিসিবি। অনুশীলনসহ অজিদের সব সুবিধা দিতে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন মেডিকেল টিম ও ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগ। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের যেরকম প্রস্তুতি নেওয়ার আমরা নিয়েছি। ভেন্যু, হোটেল এসব বিষয়ে ওদের চাহিদা অনুযায়ীই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাদের মূল চিন্তাই হল জৈব সুরক্ষা বলয় সুনিশ্চিত করা এবং তাদের খেলোয়াড়দের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।’
এই ভরা বর্ষায় এই সুরক্ষা বলয় রক্ষা করে মাঠে ক্রিকেট পরিচালিত করা। কেননা, নাক উঁচু অজিদের কঠোর কিছু শর্তের মধ্যে একটি শর্ত ছিলো এই সিরিজ সংশ্লিষ্ট সকলকেই কঠোর কোভিড প্রোটোকলের ভেতরে রাখা। সেটি করতে গিয়ে প্রায় ৯৫ জনকে ঢাকার একটি পাঁচতারকা বিশিষ্ট হোটেলে নিজ খরচায় রাখতে হয়েছে বিসিবিকে। তবুও নির্বিঘ্নে সিরিজ শেষ করার শঙ্ক জেগেছে এই বৃষ্টিকে ঘিরেই।
করোনাকালের ঝক্কি পোহাতে সিরিজের সবক’টি ম্যাচই হচ্ছে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে। ম্যাচগুলো হবেও সন্ধ্যায়। আর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মাঠকর্মীরা হোটেলে না থাকলেও তারাও থাকছেন বলয়ের মধ্যে। এরমধ্যে স্টেডিয়ামে এই সিরিজে কাজ করতে যাওয়া মাঠকর্মীদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। খেলোয়াড়দের মতো সিরিজ শুরুর আগে থেকেই তাদেরও দফায় দফায় কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর পরও ম্যাচ চলাকালীন তারা খেলোয়াড়দের কাছাকাছি যেতে পারবেন না। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে মাঠকর্মীরা বাউন্ডারি লাইনের পাশেও থাকবেন না। ক্রিকেটাররা ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার পর তাদের মাঠে ঢুকতে দেওয়া হবে। এতেই বেধেছে বিপত্তি। ম্যাচ চলাকালীন যদি বৃষ্টি আসে, তবে কি হবে? এই ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিসিবির প্রধান চিকিৎসক ও কোভিড প্রটোকলের দায়িত্বে থাকা ডা. দেবাশীষ চৌধুরীর কাছে। তিনি যা বললেন তাতে মাঠ এবং সিরিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কাটা একেবারে ঝেরে ফেলা গেল না, ‘এখন বর্ষা মৌসুম। বৃষ্টি আসতেই পারে। সেই চিন্তা আমাদের আছে। তবে খেলা বন্ধ হওয়ার পর ক্রিকেটাররা সকলে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলে তবেই মাঠে ঢুকবেন মাঠকর্মীরা। আমরা চাইছি অন্তত ৫ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে।’
এতে যে কিছুটা বিলম্বে ভেন্যুর শূশ্রুয়ায় নামতে পারবেন মাঠ কর্মীরা সেটা অনুমেয়ই। আর তাতে যে ক্ষতি হতে পারে সেটিও অজানা নয়। তারপরও কিসের টানে এমন একটি সিরিজকে এই সময়ই করা হলো? এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান আকরাম খানের কাছে। তার কাছে করোনা আর বৃষ্টির চাইতেও এই সময়ে এমন একটি দলের সঙ্গে সিরিজ খেলতে পারাটাই যে বড়! কেন? সেটিও ব্যখা করেছেন সাবেক এই অধিনায়ক। ২০১৭ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেবার ঢাকা টেস্টে অজিদের হারিয়ে ইতিহাস গড়েন সাকিব-তামিমরা। যদিও গত বছরের জুনে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তাদের। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় সিরিজটি স্থগিত হয়ে যায় দুই মাস আগেই। পরে সেটিকেই টি-টোয়েন্টি সিরিজে পরিণত করে খেলতে রাজি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সিরিজের গুরুত্ব জানিয়েছেন সাবেক এই অধিনায়ক।
আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে ওমান ও আরব আমিরাতে হওয়ার কথা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেটির প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই সিরিজটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে বিসিবি, ‘সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আমরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ খেলছি। তাদের সঙ্গে আমাদের তিনটি টি-টোয়েন্টি ছিল, সেটা পাঁচটা করতে চেয়েছি এবং ওরা রাজি হয়েছে। সময় আর আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখেই পাঁচটি ম্যাচ ৮দিনের মধ্যেই শেষ করতেই সূচি নির্ধারণ করেছি। তবে মাথায় রাখতে হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি যতটা ভালো করা যায়, সেই চেষ্টা।’
জিম্বাবুয়েতে সফল একটি সফর শেষ গতপরশু সকালেই ঢাকায় পা রাখে বাংলাদেশ দল। একই দিন বিকেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজ খেলে সরাসরি বাংলাদেশে এসেছে অস্ট্রেলিয়াও। এরই মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চলছে দু’দলের কোয়ারেন্টিন পর্ব। বাংলাদেশে প্রথম ৩ দিন রুম কোয়ারেন্টিনে কাটবে অজিদেরা। কোয়ারেন্টিন শেষে বহরের সবার করোনা পরীক্ষা করা হবে। করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ ফল সাপেক্ষে সিরিজ শুরুর আগে অনুশীলন করতে পারবেন ক্রিকেটাররা। বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী জানিয়েছেন, কোয়ারেন্টিন চলাকালে দুই দলের ক্রিকেটারদের দুইবার করোনা পরীক্ষা হবে, ‘অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ দলের এই তিন দিনে দুইবার কোভিড টেস্ট সম্পন্ন হবে। নেগেটিভ থাকবেন যারা, তারা অনুশীলনে নামতে পারবেন।’
এত কিছুর পরও যদি বৃষ্টিতে নির্বিঘ্নে সিরিজটি শেষ করতে না পারে, ক্রিকেটাররা যদি খেলতেই না পারে, সমর্থকরা যদি চার-ছক্কার বিনোদনই না নিতে পারে তবে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে প্রাপ্তি খাতায় কি জমা পড়বে বিসিবির, দেশের ক্রিকেটে! সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন