সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি : শুভংকরের ফাঁকি

প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : আইনী বাধ্যবাধকতা না থাকায় মুনাফায় ভালো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ বহুজাতিক কোম্পানি ২০ বছরেও পরিশোধিত মূলধন বাড়ায়নি। এছাড়া কোম্পানিগুলোর মোট শেয়ারের প্রায় ৮৭ ভাগেরও বেশি শেয়ার কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকেরা ধরে রেখেছেন। যার ফলে বছর শেষে খুব ভালো ডিভিডেন্ড দিলেও এসব কোম্পানির পরিচালকদের পকেট ভরছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে পড়ে থাকে নামমাত্র শেয়ার। এসব কারণেই এ কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তিকে ‘শুভংকরের ফাঁকি’ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
২০ বছরেও মূলধন বাড়ায়নি অধিকাংশ কোম্পানি, ঠকছে বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক ফায়দা হাসিলের জন্যই এখানে জনগণের নামমাত্র সম্পৃক্ততা এনেছে। কারণ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ব্যবসায়ের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। তারমধ্যে আয়কর সুবিধা অন্যতম। যেখানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিকে ৪২.৫০ শতাংশ আয়কর দিতে হয়, সেখানে শুধু তালিকাভুক্ত হলেই তাকে ৩৭.৫০ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। আর শুধু ৫ শতাংশ আয়কর সুবিধার জন্যই কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তারা বলেন, কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধনের খুব সামান্যই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকায় যথারীতি দেশের পুঁজিবাজারে এসব কোম্পানির শেয়ার সঙ্কট থাকছে। এ সুযোগে বাজারের চরম মন্দায়ও এসব কোম্পানির শেয়ার দর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে থাকে। কিন্তু হাতে প্রচুর রিজার্ভ থাকা সত্তে¡ও ১৯৯৬ সালের পর তালিকাভুক্ত অধিকাংশ বহুজাতিক কোম্পানি মূলধন বাড়ায়নি। এর ফলে কোম্পানিগুলো প্রতি বছর মুনাফার একটি বড় অংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার মাধ্যমে দেশের বাইরে নিয়ে গেলেও কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে শেয়ার স্বল্পতা নিরসনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ লিমিটেড পরিশোধিত মূলধনে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। কোম্পানিটি ১৯৮৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। যার বর্তমান পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৪ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তালিকাভুক্তির পর ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানিটি মূলধন বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই থেকে আজ অবধি কোম্পানিটি তার পরিশোধিত মূলধন আর বাড়ায় নি।
বিগত ২০ বছর ধরে একই মূলধন ধরে রেখে দেশীয় বাজারে পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে চলেছে। ২০১০ সালে শেয়ার স্বল্পতার কারণে কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার দর ২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০০৯ সালে কোম্পানিটি দেশের পুঁজিবাজারে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ৭৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। সর্বশেষ বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ৪৪.৭৫ টাকা। যার সর্বশেষ শেয়ার দর ছিল ১ হাজার ৫৪৩ টাকা। সাধারণ শেয়ারহোল্ডারের হাতে শেয়ার রয়েছে মোট শেয়ারের মাত্র ৫.৫০ শতাংশ। এরপরেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের গø্যাক্সো স্মিথক্লাইন বাংলাদেশ স্বল্প মূলধনের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ওষুধ প্রস্তুতকারী এ কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। দেশের পুঁজিবাজারে প্রায় ৩৭ বছর ধরে ১২ কোটি ৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ব্যবসা করলেও কোম্পানির পক্ষ থেকে তা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কোম্পানির মোট রিজার্ভের পরিমাণ ২৪৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট ১ কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৪৯টি শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে মাত্র ০.১৮ শতাংশ শেয়ার। এ কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে ১ হাজার ৫৬৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
চামড়া খাতের বাটা স্যু ১৯৮৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটি ১৯৮৭ এবং সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই থেকে আজ অবধি কোম্পানিটি ধারাবাহিক মুনাফায় থাকলেও আর মূলধন বাড়ায় নি। বর্তমানে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর রিজার্ভের প্ররিমাণ ২৮২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৯.২৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সারা দেশে শত শত আউটলেটের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাত করে প্রতি বছর কোম্পানিটি শতকোটি টাকা মুনাফা করলেও ১৯৯৬ সালের প্রর থেকে ২০ বছর ধরে কোম্পানিটি একই মূলধনে রয়েছে। অথচ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃৃত কোম্পানিটি বরাবরই দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পরিচিতি পেলেও শুধু মুনাফা অর্জন ছাড়া দেশের পুঁজিবাজারে মূলধন বাড়ানোর মাধ্যমে শেয়ারের অপর্যাপ্ততা নিরসনে এ পর্যন্ত কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরাবরই নগদ লভ্যাংশ দিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা স্থানান্তর করলেও বাজারে মৌলভিত্তির শেয়ার ঘাটতি রয়েই গেছে। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের বাংলাদেশ অক্সিজেন ১৯৭৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটি এখন লিনডে বিডি নামেই সবার কাছে পরিচিত। কোম্পানিটি ১৯৯৬ সালে সর্বশেষ মূলধন বাড়ায়। সেই থেকে আজ অবধি কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১৫ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মতোই প্রতি বছর ভালো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলেও মূলধন বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় নি। বিগত ২০ বছর ধরে কোম্পানিটি প্রতি বছরই মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখলেও তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে তার কোনো সুফল পাচ্ছে না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর (ব্যাটবিসি) সবচেয়ে বেশি মূলধন রয়েছে। ১৯৭৭ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন বাড়ায়। তামাকজাতপ্রণ্য প্রস্তুতকারী এ কোম্পানিটি ২৩ বছর ধরে ৬০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে এ দেশে কর্মকান্ড চালাচ্ছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৬ কোটি শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে মাত্র ০.৭৮ শতাংশ রয়েছে। অথচ দেশের পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তি বিবেচনায় বিদেশী বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। ২০১৩ সালে কোম্পানিটি ৬২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ২০১১ ও ২০১২ সালে যথাক্রমে শেয়ারপ্রতি ৪০০ ও ৫০০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। অর্থবছরের প্রতি প্রান্তিকেই প্রবৃদ্ধির উন্নতি ধরে রাখছে কোম্পানিটি। অন্যদিকে বার্জার প্রেইন্টস বাংলাদেশ ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও এ প্রর্যন্ত প্রতি বছরই নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে আসছে। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের প্ররিমাণ ২৩ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। শুরুতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য কোম্পানিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারে ১০০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়েও মাত্র ৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ে। এর ২৩ কোটি শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে মাত্র ০.৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির সময় এ ধরনের কোন শর্ত বেঁধে না দেয়ার কারণেই তাদের মূলধন বাড়াচ্ছে না। আর একটি কোম্পানি যখনই কোন আর্থিক সমস্যায় পড়ে তখনই সে মূলধন বাড়ায়। তাই কোম্পানি মূলধন বাড়াবে কি না তা কোম্পানিটির ব্যবসায়ের পারফরমেন্সের উপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের হাতে কতো শেয়ার থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা বা শর্তও দেয়া হয়নি। আর এ কারণে কোম্পানিগুলো অধিকাংশ শেয়ার নিজেদের আয়ত্তে রাখতে পারছে। পরিণতিতে বছর শেষে কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা থেকে খুব ভালো পরিমাণে ডিভিডেন্ড প্রদান করলেও তা কোম্পানির পরিচালকদের পকেটেই যাচ্ছে। তবে এ ধরনের বিশেষ সুবিধাভোগী কোম্পানির তালিকাভুক্তির সময় কিছু বিশেষ শর্ত বেঁধে দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত একটি নির্দিষ্ট সময় পার করে কোম্পানির মূলধন বাড়ানো উচিত। এতে বাজারে মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারের জোগান বাড়বে। বাজারও মৌলভিত্তির শেয়ার সঙ্কট থেকে মুক্তি প্রাবে। -ওয়েবসাইট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন