‘মাছে-ভাতে বাঙালি।’ এটি অতি প্রাচীন প্রবাদ। বাস্তবতা থেকেই প্রবাদের জন্ম। কিন্তু কাল পরিক্রমায় সেই মাছই প্রায় সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে এ দেশের মানুষের কাছে। মাছের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় মূল্য বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের পক্ষে দৈনন্দিন তো দূরে থাক ২/৩ দিন পর পর সামান্য পরিমাণে মাছ খাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশ্য ইদানিং সেই অবস্থা নেই। মাছের উৎপাদন বেড়েছে অনেক। বাজার-হাটে মাছ পাওয়া যায়। তবে মূল্য অত্যধিক, যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এখনো মাছের মূল্য আকাশচুম্বী। পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ও চাষের কই বাদে কোনো মাছই ৫/৬শ টাকার নিচে নয়। ইলিশের দাম আরো বেশি। এই অবস্থা শুধুমাত্র শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়া কালচার-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চাষে পঞ্চম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে তৃতীয়, ইলিশে প্রথম (বৈশ্বিক মোট উৎপাদনের ৮০%), সামুদ্রিক ক্রাস্টাশিয়াসে ৮ম ও ফিনফিশে ১২তম এবং তেলাপিয়ায় চতুর্থ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। বিভিন্ন তথ্য মতে, বর্তমানে মৎস্য খাতের অবদান জিডিপিতে ৪.৭৩%, কৃষিজ জিডিপিতে ২৫.৭২%, দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণীজ আমিষের প্রায় ৬০%। ১৪ লাখ নারীসহ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট, গড়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে, মৎস্য খাতের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬%, রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪.০৪% অর্জিত হচ্ছে মৎস্যজাত পণ্য থেকে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫.৫২ লাখ মে. টন। বদ্ধ জলাশয়ে ৫৬.৭৬%, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ২৮. ১৮% ও সামুদ্রিক ১৫%। (বর্তমানে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ ৪.৩৯ লক্ষ মে.টন আর ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ মে.টন)। ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য মতে, গত ১২ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৩%। গত ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিবিসি’র এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১৪৩টি মাছই ছোট মাছ। যেসব মাছ আকারে নয় সেন্টিমিটারের ছোট সেগুলোকে ছোট মাছ বা স্মল ইন্ডিজেনাস স্পেসিস কিম্বা এসআইএস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইইউসিএন’র তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৬৪টি প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মহাশোল, খরকি, পিপলা শোল, কালা পাবদা, বাঘ মাছ ইত্যাদি। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অস্তিত্বের হুমকির মধ্যে পড়া এসব মাছের বেশ কয়েকটিকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে মাছ চাষে মহা বিপ্লব সাধিত হয়েছে। তাই মৎস্য উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে।
এ কথা ঠিক, দেশে মৎস্য উৎপাদনে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ গুণ মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে গণভবন লেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করে মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার শুভ সূচনা করে বলেন, ‘মাছ হবে এ দেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ।’ তার পর থেকেই মৎস্য চাষ লাভজনক হওয়ায় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে মৎস্য চাষে। তাতে কিছু শিক্ষিত মানুষও সংশ্লিষ্ট হয়েছে। ফসলের জমি কেটে পুকুর বানিয়ে, দীঘি-পুকুর-জলাশয় সংস্কার করে এবং বাড়িতে অ্যাকুইরামে ও আঙ্গিনায় চৌবাচ্চা বানিয়ে মৎস্য চাষ করেছে। নদীতে, হাওরে, বিলে ও উপক‚লে ভাসমান খাঁচায়ও মৎস্য চাষ করা হচ্ছে। এসব স্থানে বিশাল এলাকায় নেট দিয়ে ঘেরাও করেও মাছ চাষ করা হচ্ছে। সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন আইন ও অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করেছে। দেশের বিজ্ঞানীরা বিদেশি মাছের সাথে দেশি মাছের ক্রস করে উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। উপরন্তু তারা বিলুপ্তপ্রায় ৩১ প্রজাতির দেশীয় মাছকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছেন। এভাবে দেশে মৎস্য চাষে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বড় রকমের গড়মিল রয়েছে। নতুবা বর্তমানে মাছের অগ্নিমূল্য হওয়ার কথা নয়। অতি সহজ-সরল একটি বিষয় হচ্ছে, কোনো পণ্য ডিমান্ডের চেয়ে চাহিদার সরবরাহ বেশি হলে ষড়যন্ত্র করেও তার মূল্য অধিক করা যায় না। মূল্যে ধস নামে। তাই বর্তমানে মাছের অগ্নিমূল্যের জন্য মৎস্যজীবীদের অতি মুনাফাই দায়ী নয়, চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের ঘাটতিও রয়েছে অনেক। উৎপাদন ঘাটতির দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, অনবরত বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে মাছ আমদানি ও চোরাচালানের মাধ্যমে এসে বাজারজাত হচ্ছে।
মৎস্য উৎপাদনে দেশ স্বয়ম্ভর হয়নি। ঘাটতি আছে অনেক। তাছাড়া ক্রমাগত মানুষও বাড়ছে। তাই মৎস্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ জন্য বিদ্যমান আইন শতভাগ বাস্তবায়ন ও মাছ উৎপাদনের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দ্রুত দূর করতে হবে। চাষযোগ্য মাছের ক্ষেত্রে অধিক উৎপাদনশীল মাছ চাষে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, আমিষের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি মাছের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই অধিক উৎপাদনশীল মাছ চাষে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। মূল্য হ্রাস পাবে। সাধারণ মানুষের মাছ খাওয়া বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ হবে। মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি বাড়বে। নদী, খাল, বিল, জলাশয় এবং দীঘি-পুকুর সার্বক্ষণিক সংস্কার করতে হবে। তাহলে সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত পানি থাকবে। ফলে অভ্যন্তরীণ খোলা পানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের বঙ্গোপসাগরের উপক‚লব্যাপী ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ১.৬৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত বিশাল সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক পানিসম্পদে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। সামুদ্রিক এই মাছগুলো আহরণ করতে পারলে বর্তমান আহরণের চেয়ে অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণের জন্য বড় বড় ট্রলারের ব্যবস্থা করতে হবে। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেশের মৎস্যজীবীরা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। ভারত ও মিয়ানমারের জলদস্যুরা আক্রমণ চালিয়ে আমাদের জেলেদের আহত করে এবং মাছ ও মাছ ধরার যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যায়। তাই দেশের সামুদ্রিক এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এক দৈনিককে বলেছেন, ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০’ একাদশ জাতীয় সংসদে ইতোমধ্যে পাস হয়েছে। ‘জাতীয় সামুদ্রিক মৎস্য নীতিমালা’ও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মৎস্য অধিদফতরের আওতাধীন গবেষণা ও জরিপ জাহাজ ‘আর ভি মীন সন্ধানী’ বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ২৫টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করে। জৈবিক বিশ্লেষণের ডাটাও সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ সার্ভের মাধ্যমে এরই মধ্যে সর্বমোট ৪৫৭ প্রজাতির মাছ ও মাছ জাতীয় প্রাণী শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৭৩ প্রজাতির মাছ, ২১ প্রজাতির হাঙ্গর ও রে, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির লব স্টার, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ১ প্রজাতির স্কুইলা (মেন্টিস), ৫ প্রজাতির স্কুইড, ৪ প্রজাতির অক্টোপাস এবং ৫ প্রজাতির ক্যাটল ফিশ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে ২০২০ সালে গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ আহরণের জন্য নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।’ এই প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং ‘জাতীয় সামুদ্রিক মৎস্য নীতিমালা’ দ্রুত চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন করা দরকার। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের জন্য বিদেশি কোনো প্রস্তাব পাওয়া গেলে তাতে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো উচিৎ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অধিক উৎপাদনশীল মাছের এলাকায় প্রয়োজনীয় মৎস্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা তথা কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করা দরকার। কারণ, মাছের ভরা মওসুমে অধিক আহরণকৃত মাছ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হয়ে যায়। এতে জেলেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড় বন্যা হলে বিপুল পরিমাণে মাছ ভেসে চলে যায়। এটা রোধ করার পন্থা আবিষ্কার করা দরকার। নদীর মোহনাগুলো নিরাপদ রাখা প্রয়োজন। কেননা, গবেষকদের মতে, পানির তলদেশে যে স্থানটি উর্বর, সেটি প্রাণ-প্রকৃতির আধার। মোহনাগুলোতে খাবার থাকে বেশি, পানি থাকে মিশ্রিত। এরকম পরিবেশ ইলিশসহ সব ধরনের মাছের অত্যন্ত প্রিয়। মৎস্যজীবীরা প্রয়োজনীয় সরকারি ঋণ পায় না। তাই তারা দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে চড়া সুদে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে তাদের প্রয়োজন মোতাবেক। মাছ ধরা নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের কিছু আর্থিক সহায়তা করা হয়। সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এতে তাদেরকে চরম কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়। জেলেদের আর্থিক সহায়তার পরিমাণ প্রয়োজনানুগ হওয়া দরকার। অধিক মৎস্য উৎপাদনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মৎস্য চাষের সব বাধা দূর করতে হবে। অধিক মৎস্য উৎপাদনের গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। অপরদিকে, মাছ চাষ খুবই লাভজনক। তাই মাছ চাষে অধিক মনোযোগ দেওয়া দরকার মৎস্য চাষিদের। তবে, সেটা অবশ্যই মৎস্য আইন পালন করে। এ ক্ষেত্রে যুবকদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাহলে বেকারত্ব দূর হবে। স্বাবলম্বী হবে। দেশের কল্যাণ হবে। ভোক্তাদেরও উচিৎ নিষিদ্ধ ঘোষিত মাছ ক্রয় না করা। দেশের বেশিরভাগ শিশুর প্রবল অনীহা রয়েছে মাছের প্রতি। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কম বয়সেই চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই অভিভাবকদের উচিৎ-সন্তানদের প্রয়োজন মোতাবেক মাছ খাওয়ানো।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন