শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ লাগানো প্রয়োজন

এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। সারাদেশে কোন না কোন স্থানে বজ্রপাতে মানুষ, গবাদিপশু ও বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে। আবহাওয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে। মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন প্রতি বছর বর্ষাকালে বজ্রপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছরে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত সাড়ে ৯ বছরে বজ্রপাতে দেশে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে বজ্রপাতে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ২৭৬ জন। ২০১১ সালে মারা গেছে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে মারা গেছে ২০১ জন, ২০১৩ সালে মারা গেছে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে মারা গেছে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে মারা গেছে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে মারা গেছে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে মারা গেছে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে মারা গেছে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে মারা গেছে ১৯৮ জন, ২০২০ সালে মারা গেছে ২১১ জন এবং ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মারা গেছে ১০৭ জন। বজ্রপাতে প্রতিবছর গড়ে দুই শতাধিক মানুষ মারা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসাবে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে বজ্রপাত বেশি হয়। বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে তালগাছ লাগানোকে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ বেশ কার্যকর। বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হতে পারে। তালগাছের পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ এর মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরী। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রকৃতিই বাঁচার উপায়।

বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশ, নয় সারাবিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ কাজে লাগানো দরকার। সরকারি উদ্যোগে তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই কার্যক্রমকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। তালগাছ লাগানোর পাশাপশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ৩১ লাখ ৬৪ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।

নাসার তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট বাংলাদেশ। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাকৃতিকভাবে লম্বা গাছ যেমন তাল গাছ, সুপারি গাছ, নারকেল গাছ, বট গাছ কমে যাবার কারণেও বজ্রপাত এখন যেখানে সেখানে আঘাত হানছে। আগে বড় বড় বটগাছ, তালগাছ ও সুপারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় বজ্রপাত হতো এসব গাছের ওপর। বড় বড় গাছ কেটে ফেলায় বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসতবাড়িতে, রাস্তার পাশে, ফসলি জমির আইলে তালগাছ, সুপারি গাছ, নারকেল গাছ রোপণ করতে হবে।

বজ্রপাত প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘প্রতিবছর যে হারে গাছ কাটা হয় সে অনুপাতে গাছ রোপণ করা হয় না। আগে গ্রামের মাঠঘাটে তালগাছ দেখা যেত। তালগাছ বজ্রপাত ঠেকানোর অন্যতম উপায়। এখন তালগাছের সংখ্যা কমে এসেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে মাঠেঘাটে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি বাড়িতে আরথিন ব্যবস্থা সেট করতে হবে।’ মোবাইল টাওয়ারগুলোতে আরথিনের ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাত মোকাবিলায় দালানকোঠা নির্মাণের সময় বজ্র নিরোধক লাগাতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বজ্রপাতের আঘাত থেকে রেহাই পেতে হলে কিছু সতর্কমূলক ব্যবস্থা সবার জেনে রাখা ভালো। বজ্রপাতের শঙ্কা থাকলে পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। উঁচুস্থান পরিহার করতে হবে। বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের শঙ্কা বেশি থাকে বিধায় বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। ঘরে থাকলে জানালা থেকে দূরে থাকতে হবে। ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। বজ্রপাতে শুধু প্রাণহানি হয় না, নষ্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও, বিধায় এসময় ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর সুইচ বন্ধ করে রাখা উত্তম।

বজ্রপাতের মতো আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, গ্রামে-গঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারিকেল গাছ থাকলে সেগুলো বজ্রনিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। খোলামাঠ, রাস্তার পাশে এমনকি বিল, হাওড়-বাঁওর ও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে উঁচু তালগাছ লাগাতে হবে। তাল, নারকেল, সুপারি প্রভৃতি উঁচু গাছ লাগানো যেতে পারে। এর মধ্যে বজ্রপাত নিরোধক হিসাবে তালগাছ উল্লেখযোগ্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন