বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

নীলম পাড়ের দুঃখগাথা

প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমদ রাজু
সমাজের সবকিছু যদি স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত হতো তাহলে তো কথাই ছিল না। দু’একজনের কাছে স্বাভাবিক হলেও অধিকাংশের কাছে অন্য রকম জীবন সেটা। প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্ত যাদের থাকতে হয় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। মৃত্যুর ডাক আসতে পারে যখন তখন।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে লড়াই চলে আসছিল। লাইন অব কন্ট্রোলের মাধ্যমে কাশ্মীর বিভাজনের মধ্যদিয়ে ১৯৪৮ সালে সে লড়াই শেষ হয়। শান্তির লক্ষ্যে এমন উদ্যোগ নিলেও সীমান্তবর্তী অনেক এলাকার মত পাহাড়ি কেরান গ্রামে শান্তির ছোঁয়া লাগেনি। বিশেষ করে গ্রামটি সীমান্তের মাঝে পড়ে যাওয়ায় দিন পরিবর্তনের সাথে এলাকার শান্তি হারিয়ে যায় দূর থেকে আরো দূরে।
লাইন অব কন্ট্রোলের মাঝের সবুজ শ্যামল পাহাড়ি সৌন্দর্যবিস্তৃত গ্রাম কেরান। কাশ্মীর উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত এলাকার এই গ্রামে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব ছবি। দুই পাহাড়ের মধ্যদিয়ে আপন মনে বয়ে গেছে নীলম নদীর সরু প্রশাখা। পাহাড়ে জুম চাষ আর নীলম নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এলাকার মানুষ। সীমান্তের গ্রামে একটু আধটু উত্তেজনা থাকলেও ভারত-পাকিস্তানের টানাপোড়েনে তা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়। পৃথিবী যতই আধুনিকতার দিকে ধাবিত হয় ততই উত্তেজনা বাড়ে।
কাওছার বাট জীবনের ছত্রিশ বছর পার করেছে। তার এক জীবনে এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে সে অনেক মৃত্যু দেখেছে। দেখেছে তার ছোট ভাই-বাবাকে জীবন দিতে, বংশের আরো অনেক অনেককে; যাদের প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে- চোখের সামনে ভাসে তাদের অলিখিত স্মৃতি। দিনে দিনে তার নিজের বাঁচার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে। একেতো সীমান্ত উত্তেজনা তার ওপর পাঁচ জনের সংসার চলে অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে। তাছাড়া গত তিন বছর ইঁদুরের উৎপাতে জুম চাষ বন্ধ হবার উপক্রম। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় সংসার যেন চলতেই চায় না। যদি নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া যেত কিংবা কোন কমলা লেবু বাগানে কাজ হতো তাহলেতো কথাই ছিল না। যদি কেরান গ্রামটা ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী না হতো এক কথা ছিল। এই উত্তেজনার মধ্যে কে দেবে তাকে কাজ?
ক’দিন আগেও অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল দৈনন্দিন জীবন। তখন জুম চাষ হতো আর নীলম নদীতে মাছ পাওয়া যেত। জুম চাষ আর মাছ বিক্রির টাকায় যেভাবে সংসার চলতো সেভাবেই থাকার ইচ্ছা গ্রামের সকলের। দিন বদলাবার সাথে তা সম্ভব হয় না। জুম চাষ বন্ধ। নীলম নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে উপহাস করা। নদীর ওপারে পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষী আর এপারে ভারত। নদীর পানিতে নামা নিষেধ। গ্রামের ভেতর পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট সরু শাখা নদী এখন অনেকের ভরসা। সামান্য ক’জন আছে যারা দূর পাহাড়ে লেবু-আপেল বাগানের শ্রমিক। সে সংখ্যা অতি নগন্য।
১৯৯০ সাল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিছুই করার নেই। নদী থেকে লাশ তুলে দাফন করা মানেই আরো অনেক মৃত্যু। কাওছার বাট নীরবে চোখের জল ফেলেছে।
কাওছার বাট তার স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে রাতের আঁধারে কেরান গ্রামের অন্যান্যদের সাথে সীমানা পেরিয়ে কাশ্মীরের পাকিস্তানী অংশে আশ্রয় নেবার জন্য ঘর থেকে বের হয়। ভাগ্য নেহাৎই খারাপ না হলে এমন হবার কথা নয়। কাওছার বাট তার স্ত্রীর আর ছোট মেয়ে তহুরা জানকে নিয়ে সীমানা পেরোতে পারলেও বড় মেয়ে মালেক জান অন্য একজনের কোলে থাকায় সে আর পার হতে পারেনি। কোন উপায় না দেখে মালেক জানকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, যারা সেদিন সীমানা পার হতে পারেনি।
সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাঁচ বছরের মেয়ে মালেক জান। বাবা-মা’র জন্যে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে ওঠে তার। এখন ইচ্ছে করলেও সীমানা পেরিয়ে বাবা-মার কাছে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু তার পক্ষে কেন, এই কেরান গ্রামের কেউ-ই, সাহস করে তাকে পার করে দিতে রাজি হয় না। যে এই দুঃসাহস দেখাবে তাকেই জীবন দিতে হবে সীমান্ত রক্ষীর হাতে। প্রতিবেশীরা বর্তমান পরিস্থিতি ছোট্ট মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তার কান্না থামে না।
উত্তেজনা কমে গেলে কেরান গ্রামে ফিরে আসার ইচ্ছা থাকলেও ধীরে ধীরে মন থেকে তা মুছতে হয় কওছার বাটের। মাত্র পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে মালেক জানকে ফেলে আসায় মন উতলা হয়ে থাকে সারাক্ষণ। মালেক জানের মা মেয়ের জন্যে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। সে জানে না তার মেয়ে এখন কোথায় আছে, কী করছে।
মালেক জান নীলম নদীর ধারে এসে চোখের জল মিশ্রিত ডাক দেয়, মা, ওমা; বাবা, ও বাবা। আমি তোমাদের কাছে যাবো। আমাকে নিয়ে যাও। মালেক জানের ডাক তার বাবা-মা শুনতে পায় কিনা জানেনা সে। তবে প্রতিদিন এসে নীলম নদীর ধারে এসে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর চোখের জল ফেলে শুকনো বাইন পাতার ওপর।
কাওছার বাট আশ্রয় নিয়েছে কাশ্মীরের পাকিস্তানী অংশের পাহাড়ি এলাকায়। এখানে তিন চার হাজার মানুষ অস্থায়ী বসতি গড়ে একপ্রকার জনবিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছে। ঘরগুলো তৈরি করেছে পাহাড়ের ঢালুতে কাঠ দিয়ে। পাকিস্তানের সরকারী সাহায্য-সহযোগিতা কিংবা সুযোগ সুবিধা কোন কিছুই পায় না তারা। সেখানে জীবনের নিরাপত্তা আছে এমন নয়। বিভিন্ন সময় মৌলবাদীরা এসে হানা দেয়। তাদের হাতে কেউ কেউ মারা যায়; কেউ জখম হয়। কাওছার বাটদের অপরাধ তারা ভারতীয়।
নিজ ভূমি থেকে পালিয়ে আসা বড় বেশি ভুল বলে মনে হয় কাওছার বাটের। ফেলে আসা ছোট্ট মেয়েটার জন্যে বুকে পাথর চেয়ে হা-হুতাশ করে। হৃদয় নিংড়ানো ইচ্ছে সত্ত্বেও কিছু করার নেই তার।
মালেক জানের কান্না থামে না। সে কেঁদে চলে দিন-রাত। বাবা-মা, বোন কেউ তার কাছে নেই। মালেক জানের আশ্রয় হয় দূর সম্পর্কের আত্মীয় বৃদ্ধা জাকারিয়া বাটের কাছে। বৃদ্ধা তাকে নিজের নাতনীর মতো মানুষ করে। গোসল করিয়ে দেয়- চুল বেঁধে দেয়। বৃদ্ধার কাছে আশ্রয় পেয়ে অনেকটা দুঃখ ভুলে যায় মালেক জান।
সংসারে অভাব আছে। সচ্ছলতা কাকে বলে জানে না নীলম পাড়ের এই কেরান গ্রামের জনগণ। তারপরও এক হত দরিদ্র বৃদ্ধা মালেক জানকে সংসারের একজন করে নিয়েছে তাতেই খুশি মালেক জান। নীলম নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বাবা-মাকে এই ক’বছরে অনেকবার ডেকেছে। তার সে ডাক বাবা-মা শুনেছে কিনা তা জানেনা মালেক জান। তবে নিজের ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসে কানে বেজেছে মালেক জানের।
কেউ একদিন আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেছিল, নদীর ওপারের পাহাড়ের গায়ে ঐ যে কাঠের যে বাড়িটা দেখা যায়, ওখানেই তোমার বাবা-মা থাকে। সেই থেকে অপেক্ষার প্রহর গোনে মালেক জান। ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সমাধান হবার সাথে সাথে তার বাবা-মা ফিরে আসবেন কেরান গ্রামে। কিন্তু কবে? কতদিন-কতকাল-কতবছর? মালেক জান দিন গুনতে গুনতে কিশোরী থেকে পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠে; যা তার শরীর জানান দেয়।
বৃদ্ধা জাকারিয়া বাট মারা গেছে মালেক জানের বয়স পনের পার হবার তের দিন আগে এক বৈশাখের রাতে। তারপর সে নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করে। বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। গ্রামের অন্য মেয়েদের সাথে কমলা লেবু বাগানে কাজ নেয়। নিজের উপার্জনে চলে তার দিন। পারিশ্রমিক পুরুষদের থেকে অর্ধেক। কারণ তারা মেয়ে। আর মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অর্ধেক পারিশ্রমিক পাবে এটাই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে মালেক জানের কোন অভিযোগ নেই। তার ধারণা, সে যে পারিশ্রমিক পায় তাই সঠিক। সেটাই নিয়ম। এ ধারণা শুধু মালেক জানের নয়; গ্রামের সকল মেয়েদের। যারা মালেক জানের সাথে লেবু বাগানে কাজ করে।
হোসেন বাট গ্রামের তরতাজা যুবক। বাবা অনেকদিন আগে কাশ্মীরের পাকিস্তানী অংশে পাড়ি জমিয়েছে আর ফিরে আসেনি। মা মারা যায় ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি  চার ভাইবোনকে নিয়ে সেই থেকে সংগ্রামী জীবন শুরু। সংসারের হাল ধরে।
মালেক জান আর হোসেন বাট একই বাগানের শ্রমিক। দু’জন দু’জনকে খুব ভালো করে চেনে- জানে। গ্রামের মুরব্বীরা সিদ্ধান্ত নেয় ওদের দু’জনকে এক করে দেবার। উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতেও হোসেন বাট আর মালেক জানের বিয়ে হয়।
সংসার শুরু হয় মালেক জানের। সে এখন আর বাগানে কাজ করে না। হোসেন বাট তাকে আর বাইরে কাজ করতে দিতে রাজি নয়। তার কথা, মালেক জান সংসার সামলাবে আর বাইরে কাজ করে রোজগার করবো আমি। মালেক জান স্বামীর কথার অবাধ্য হয় না। সে সংসার সামলায় আপন মনে।
ভারত-পাকিস্তানে খ- খ- যুদ্ধ চলায় অন্যান্য এলাকার মতো কেরান গ্রামের অনেক মানুষ মারা গেছে ইতিমধ্যে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবাই কমবেশি। সীমান্ত নিয়ে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কিছুটা কমে এলেও নীলমপাড়ের বাসিন্দাদের ঘরে ফেরার সম্ভাবনা এখনো নেই বললেই চলে। ২০০৩ সালে যুদ্ধ বিরতির পর কেরান গ্রামটি নীলমের দুই পাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা এখন নদীর দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে আপনজনদের ডাকেন-দেখা করেন।
সম্প্রতি কাশ্মীরের সেনা সদর দফতরে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে নতুন করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। ওই হামলায় ২০ সেনা সদস্য নিহত হওয়ার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। একই সঙ্গে পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তবে এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। কিন্তু বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দু’দেশের মধ্যে নতুন করে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তাতে দুর্ভোগ বেড়েছে নীলমের দুই পাড়ের অধিবাসীদের। এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় নীলমপাড়ের অধিবাসীদের দিন কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া কাওছার বাট আর তার স্ত্রী অশ্রু ভেজা চোখে এই উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেও নীলম নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে নিজের মেয়ের নাম ধরেন ডাকেন। বাবার ডাক শুনে এপারে নদীর কিনারে এসে দাঁড়ায় মালেক জান। বাবা-মাকে কাছে পাবার জন্যে তার ব্যাকুল হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। চোখে জল উছলিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে নদীর পানিতে মিশে যায়। অথচ বাবা-মেয়ের মিলন হবার সুযোগ নেই।
মালেক জান জানে না এই সমস্যা থেকে তাদের মুক্তি আছে কী-না। আর কবেইবা তার বাবা-মা ফিরে আসবে এই কেরান গ্রামে? যেখানে তিন সন্তান নিয়ে মালেক জানের সংসার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন