গতি শব্দটা যেন বাংলাদেশ বোলিং লাইনআপ থেকে হারিয়েই গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম চার ম্যাচে দুই পেসার মুস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনরা খেললেও উইকেটের চরিত্রের কারণে তারা কাটার, নাকল বলের মতো কম গতির বলই বেশি করছিলেন। চতুর্থ ম্যাচ জিতে সিরিজ জয় নিশ্চিত করার পর গতকাল শেষ ম্যাচের উইকেটে আসে পরিবর্তন।
আর তাতে বাংলাদেশ দলের বোলিং আক্রমণ হয়ে যায় কার্যত তিন বোলার কেন্দ্রিক। তবে বাংলাদেশের বোলার শূন্যতার সুবিধাটা পুরোপুরি নিতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। টসে জিতে তুলনামূলক ভালো ব্যাটিং উইকেটে দারুণ শুরুর পরও সফরকারীরা করে ৫ উইকেটে ১৬১ রান। সিরিজ জয়ের ব্যবধান ৪-১ করতে বাংলাদেশ দলের দরকার ছিল ১৬২ রান। তবে সেই গতির ঝড়ের কাছেই হার মানে রাসেল ডমিঙ্গোর শিষ্যরা। ৮ উইকেটে থামে ১৩৪ রানে। ২৭ রানের হারে বাংলাদেশ সিরিজ শেষ করে ৩-২ ব্যবধানে।
সিরিজের প্রথম চার ম্যাচ খেলা হয়ে দুটি উইকেটে। গতকাল পঞ্চম ম্যাচে খেলা হয়েছে নতুন ও তরতাজা উইকেটে। আগের ম্যাচগুলির মতো উইকেট মন্থর হবে না, সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। আর তাতে পরিবর্তন আসে বাংলাদেশ একাদশেও। ক্রিকেটারদের চোটও আরেকটি কারণ। যার কারণে চারটি পরিবর্তন এনে খেলতে নামে বাংলাদেশ দল। দুই পেসার মুস্তাফিজ ও সাইফউদ্দিনের জায়গায় সুযোগ পান তাসকিন আহমেদ ও শরীফুল ইসলাম। সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান না থাকায় সিরিজের দলে প্রথম বারেরমতো সুযোগ পান সৌম্য সরকার, ছিলেন বিশ^কাপের দলে ডাক পাওয়া শামীম হোসেন পাটোয়ারীও।
কিন্তু তাসকিন দলে ফেরায় টানা ৯ ম্যাচ পর এদিনই প্রথম স্পিড মিটারে চোখ দেওয়ার আগ্রহ জাগে মিডিয়া বক্সে আসা ক্রীড়া সাংবাদিকদের। কারণ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সিরিজের ৯ ম্যাচ পর এদিনই প্রথম পেসার দিয়ে ইনিংসের শুরু করেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। নতুন বল হাতে পেয়ে তাসকিনও গতির ঝড় তোলেন। দুই ওভারের প্রথম স্পেলে মাত্র ৭ রান দেন তিনি। এর মধ্যে স্পিডমিটারকে একবার ৯০ মাইলও পেরোতে দেখা গেছে।
তবে একটু ব্যাটিং সহায়ক উইকেট বাংলাদেশের বাকি দুই বিশেষজ্ঞ বোলার খুব একটা পছন্দ করছিলেন না। শরীফুল ও নাসুম দুজনই ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে ছিলেন খরুচে। কিউই ওপেনার ফিন অ্যালেন এদন হাত খুলে খেলার স্বাধীনতা পেয়ে তেতে ওঠেন। চার-ছক্কার বৃষ্টি নামিয়ে ২৪ বলে ৪১ রান করেন অ্যালেন। তার সাথে আরেক ওপেনার রচিন রবীন্দ্রকে পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে আউট করেন শরীফুল। ওপেনিং জুটিতে ৫৮ রান নিউজিল্যান্ড ইনিংসকে এনে দেয় মজবুত ভিত। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারের চতুর্থ বলে ক্যাচ তুলে আউট হন রবীন্দ্র। পঞ্চম বলে আউট হন অ্যালেন। সেবার রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেও পরের বলেই লেগ স্টাম্পে বলের লাইন মিস করে বোল্ড হয়েছেন।
এ জুটি অবশ্য ৫৬ রানই বাড়তি পেয়েছিল। নাসুমের প্রথম বলেই যে ক্যাচ আউট হমে পারতেন রবীন্দ্র। শামীম হোসেন মিড উইকেট বাউন্ডারিতে তখন ১ রানে থাকা রবীন্দ্রর ক্যাচ না ছাড়লে জুটিটা ২ রানেই থামত। মাঝের ওভারে অবশ্য নিউজিল্যান্ডের রানের গতি কমাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ দল। অনিয়মিত বোলাররাও এই সময়টা ভালো বোলিং করেন। আফিফ হোসেন, শামীম হোসেন, সৌম্য সরকার ও অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ নিজেও হাত ঘুরিয়ে সাফল্য পান। আফিফের বলে উইল ইয়াং আউট হন। আর নাসুম বোলিংয়ে ফিরে টানা চতুর্থবারের মতো কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে আউট করেন। নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং যখন বিপদে, তখন ৩৫ বলে ৩৫ রানের জুটি গড়েন অধিনায়ক ল্যাথাম ও হেনরি নিকোলস।
দুজনই ডেথ ওভারে দ্রুত কিছু রানের খোঁজে ছিলেন। ১৭তম ওভারে ওয়াইড ইয়র্কারে নিকোলসকে নুরুল হাসানের অবিশ্বাস্য ক্যাচে পরিণত করেন তাসকিন। আর তাতেই ভাঙে ভয়ংকর হয়ে ওঠা ল্যাথাম-নিকোলস জুটি। পরে অবশ্য ক্ষতিটা একাই পুষিয়ে দেন ল্যাথাম। তাসকিনের ১৯তম ওভারে দুটি ছক্কা ও একটি চার মেরে ১৮ রান তোলেন কিউই অধিনায়ক। শেষ ওভারে পূর্ণ করেন সিরিজে তার দ্বিতীয় ফিফটিও। তার ইনিংসে ৩৭ বলে অপরাজিত ৫০ রানের ইনিংসে নিউজিল্যান্ড ৫ উইকেট হারিয়ে করে ১৬১ রান।
বড় রান তাড়ায় বাট করতে নেমে বাংলাদেশও দেখেছে গড়ির ঝড়। তাদের নতুন পেসার বেন সিয়ার্স-তো নিয়মিতই তুলেছেন ১৪৪ থেকে ১৪৭ কিলোমিটার! আর তাতে লড়াই করলেও জয়ের নাগাল পায়নি মাহমুদউল্লাহরা।
তবে একটা সময় মনে হয়েছিল অনেকদিন পর টি-টোয়েন্টির আসল আমেজই বুঝি দিতে যাচ্ছে মিরপুরের উইকেট। বাজে শটে একের পর এক উইকেট পতনে অস্বস্তি ভর করেছিল বাংলাদেশ শিবিরে। তবে দক্ষ হাতে আফিফকে নিয়ে সেই সঙ্কট কাটিয়ে তুলেছিলেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। তাদের চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটানো ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ১৫ ওভারেই একশ’ পেরিয়েছিল বাংলাদেশ। জয়ের জন্য তখন বাংলাদেশের চাই ৩০ বলে ৫৬। টি-টেয়েন্টিতে খুবই সম্ভব। তবে অধিনায়কের (২২ বলে একটি করে চার ছক্কায় ২৩ রান করেন মাহমুদউল্লাহ) বিদায়ের পর এক পাশ আগলে রেখে অপরাজিত থেকেও জয় এনে দিতে পারেননি বাংলাদেশকে, মাত্র এক রানের জন্য ফিফটি বঞ্চিত হন আফিফও। ৩৩ বলে ৩টি ছক্কার আর দুটি চারে ৪৯ রান করেন আফিফ।
বিশ্বকাপ দলের একজনকে না নিয়ে এসেও দারুণ পারফরম্যান্সে নিউজিল্যান্ড দেখিয়ে দিল তাদের ক্রিকেটের গভীরতা। প্রথম ম্যাচের পর প্রতি ম্যাচেই উপহার দিল তারা দারুণ লড়াই। নিউজিল্যান্ডের পেস-স্পিনের সম্মিলিত বোলিং আক্রমণ কার্যকর বোলিংয়ে আটকে রাখে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। শেষ পর্যন্ত সিরিজ তারা জিততে পারেনি, তবে অনভিজ্ঞ দল নিয়েও এমন উইকেট ও কন্ডিশনে ৩-২ ব্যবধানের হারে তারা মাথা উঁচু রাখতেই পারে। বিশ্বকাপের আগে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের দুর্দশা, বিশ্বকাপ নিয়ে তুলে ধরছে শঙ্কার ছবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন