শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে : কুড়িগ্রামের উলিপুরে ডিলার নিয়োগ ও উপকারভোগীর তালিকা তৈরিতে সীমাহীন দুর্নীতির কারনে ১০ টাকা কেজি দরে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ডিলার নিয়োগে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সাথে কর্মকর্তাদের রশি টানাটানির কারণে স্বল্পমূল্যের চাল উপজেলার প্রায় ২০ হাজার উপকারভোগীর ভাগ্যে জুটছে না। উপকারভোগীর তালিকা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে প্রণয়নের বিধান থাকলেও সেখানে ক্ষমতাসীন দল, সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ভাগ বসানোয় তালিকা তৈরিতে বিলম্ব হয়। অভিযোগ উঠেছে, তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হতদরিদ্র এসব মানুষকে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা দালালদের মাধ্যমে গুনতে হচ্ছে। বুধবার এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত উপকারভোগীদের মাঝে কার্ড বিতরণ করতে না পারায় এ কার্যক্রম নিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চিলমারী থেকে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকল্পে খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের আওতায় পল্লী অঞ্চলের হতদরিদ্রদের স্বল্প মূল্যে খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য ফেয়ার প্রাইজ কার্যক্রম চালু করেন। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল বছরের ৫ মাস কার্ডধারী এসব হত-দরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি মূল্যে বিক্রি করবে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ডিলার নিয়োগ ও ইউপি’র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে উপকারভোগীর তালিকা তৈরি করার কথা। কিন্তু এ উপজেলায় শুরুতেই তার ব্যত্যয় ঘটে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র উপজেলা চেয়ারম্যান ও জাপা এমপি’র প্রতিনিধি উপকারভোগীর তালিকায় তাদের পছন্দমত ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে দরকষাকষি শুরু করলে ইউপি চেয়ারম্যানদের সাথে দ্ব›দ্ব দেখা দেয়। পরবর্তীতে ২৪ হাজার ২০৮ জন উপকারভোগীর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩০ ভাগ, উপজেলা চেয়ারম্যান ৫ ভাগ, এমপি’র প্রতিনিধিকে ৫ ভাগ ছাড় দিয়ে তালিকা তৈরির ব্যাপারে সমঝোতা করা হয়। অবশিষ্ট ৬০ ভাগ সংশ্লিষ্ট ইউপি’র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তালিকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে, উপজেলায় প্রস্তাবিত ৪৫ জন ডিলারের মধ্যে পূর্বের নিয়োগকৃত ২৪ জন ডিলার থাকায় অবশিষ্ট ২১ জন ডিলার নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল, এমপি প্রতিনিধি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু হয়। এর মধ্যে ডিলারশিপ পাওয়ার জন্য অনেকেই অর্থলগ্নি করে নেতাদের কাছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের মাঝে উপদলীয় কোন্দল দেখা দেয়।
এসব নেতা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ডিলার নিয়োগ দেয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আবেদন জমা দেয়ার শেষ তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর হলেও অফিসকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন জমা নিতে বাধ্য করেন। সর্বশেষ ১৩টি ইউনিয়নের বিপরীতে ২১ জন ডিলার নিয়োগের জন্য মোট ৯৪ টি আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদনকারির অধিকাংশই শর্ত পুরণে ব্যর্থ হয়। অভিযোগ রয়েছে, দলদলিয়া ইউনিয়নের ৬ আবেদনকারির মধ্যে যাচাই-বাচাই কালে রাসেল সরদার ছাড়া বাকি ৫ জনের আবেদন ছিল ত্রæটিপূর্ণ। কিন্তু এখানে টাকার বিনিময়ে রাসেল সরদারকে নিয়োগ না দিয়ে আবেদ আলী নামের একজনকে প্রাথমিকভাবে নিয়োগ করা হয়। সে স্থানীয় ভাবে বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত। এ নিয়োগের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে নেতাকর্মীদের মাঝে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একই অবস্থা সবকটি ইউনিয়নে। অফিস পাড়ায় গুঞ্জন রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের ডিলার নিয়োগে কর্মকর্তাদের চাপ দিলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এসব কারনে ডিলার নিয়োগ ও উপকারভোগিদের মাঝে কার্ড বিতরণ নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গত সেপ্টেম্বরসহ চলতি মাসের বরাদ্দকৃত চাল উপকারভোগিদের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। বাজারে হঠাৎ মোটা চালের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকারভোগীরা প্রতিদিন চাল কেনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় দিনভর ধর্না দিয়ে ফিরে আসছে।
ভারপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা শামছুল আলম জানান, ১৩টি ইউনিয়নের সুবিধাভোগীদের নামের তালিকা ও ডিলার নিয়োগে বিলম্ব হওয়ায় চাল বিতরণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয় দেখভাল করছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম হোসেন মন্টু বলেন, ২/১ ইউনিয়নে ত্রæটি থাকলেও বাকিগুলোতে সঠিকভাবে হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, ডিলার নিয়োগের দুর্নীতির বিষয়টি খাদ্য কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন