সন্তান মানুষের জন্য মূল্যবান সম্পদ ও দুনিয়ার সৌন্দর্য স্বরূপ। এই অমূল্য সম্পদকে যেভাবে প্রতিপালন করা হবে ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠবে। ছেলে-মেয়েকে ইসলামী আদর্শে গড়ে তুললে তারা দুনিয়াতে যেমন উপকারে আসবে তেমনি পিতামাতার জন্য তারা পরকালে মুক্তির কারণ হবে। জনৈক ব্যক্তিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করা হলে সে অবাক হয়ে বলবে, এমন মর্যাদা কোন আমলের বিনিময়ে পেলাম? আমিতো এতো সৎআমল করিনি। বলা হবে, তোমার জন্য তোমার সন্তানের প্রার্থনার কারণেই তোমাকে এ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। (মুসনাদে আহমদ: ১০৬১৮, ইবনু মাজাহ: ৩৬৬০) মানুষ মৃত্যুবরণ করলে সৎ সন্তানের দুয়া পিতামাতার উপকারে আসে ( সহিহ মুসলিম: ১৬৩১, মিশকাত ২০৩) নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি সন্তানদেরকেও বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করো ( সূরা তাহরীম- ০৬) সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পিতামাতার কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল-
সন্তানের জন্যে ভালো মা নির্বাচন করা: সন্তানের যেমন পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য আছে তেমনই পিতা-মাতারও সন্তানের প্রতি কর্তব্য আছে। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যগুলো শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয় সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার কর্তব্য। এগুলো সন্তানের অধিকার। সন্তান জন্মের আগে থেকেই তার অধিকার শুরু হয়। সন্তানের রয়েছে আদর্শ, দীনদার মায়ের কোলে জন্মগ্রহণের অধিকার। তাই মায়ের জন্য একজন সৎ ও চরিত্রবান বাবা, আর বাবা হলে একজন নেক্কার মা নির্বাচন করা। দারিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা না করা: সন্তানকে নিজের জীবনের জন্য মুসিবত মনে করা মারাত্মক অপরাধ। মানুষের হাতে গড়া নোংরা সভ্যতা মানুষের মস্তিষ্ক এক কথা বদ্ধমূল করে দিচ্ছে যে, এক বা দুইয়ের অধিক সন্তান দারিদ্রতা বয়ে আনে। সন্তান সুখের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে সুতরাং সন্তানকে পৃথিবীতে আসতে দেওয়া যাবেনা। সন্তান যাতে গর্ভে প্রবেশ করতে না পারে প্রসবকালে গর্ভপাত ঘটানো অথবা গর্ভের সন্তানকে হত্যার ব্যবস্থা করতে হবে। অতীতকালে জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক ঘৃণ্য ব্যবস্থা না থাকায় সন্তান জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই হত্যা করা হতো। ইসলাম এ জঘন্য পাপ থেকে মানুষকে শুধু বিরতই করেনি পিতা-মাতার হৃদয়ে সন্তানের জীবনের মূল্য ও মর্যাদার প্রবল অনুভূতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করা হতো নিষ্পাপ অবোধ শিশু সন্তানকে। ইসলাম এর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, খাদ্যের মালিক তোমরা নও। আল্লাহ অসীম অনুগ্রহ করে তোমাদেরকে খাদ্য দান করেন। অতীতকালে সন্তান হত্যা করা প্রথায় পরিণত হয়েছিল। ইসলাম সেই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। আরবে সন্তান হত্যার নিষ্ঠুর কাহিনী ইতিহাসের পৃষ্ঠা কলঙ্কিত করে রেখেছে।
কানে আযান ও একামত দেয়া : সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক তাকে গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া এবং বাম কানে একামত দেয়া সুন্নাহ। এটি পিতা-মাতার উপর এজন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যে, শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁঁছে দেয়া এবং ওত পেতে থাকা শয়তান যেন তার কোন ক্ষতি করতে না পারে। হযরত আবু রাফে থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি মহানবী (সা.)-কে দেখেছি, ফাতিমা (রা.)-এর গর্ভে হযরত হাসান (রা.) জন্মগ্রহণ করলে তিনি তাঁর কানে নামাজের আজানের মতো আজান দিয়েছেন। (তিরমিজি, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮৩) মহানবী (সা.) বলেন, যখন তোমাদের সন্তানেরা কথা বলতে শেখে তখন তাদের কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু শিক্ষা দাও (বায়হাকি)।
তাহনিক করা: তাহনিক অর্থ খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে সন্তানের মুখে দেয়া। আয়েশা রা: বলেন : ‘রাসূল সা:-এর কাছে শিশুদেরকে আনা হলে তিনি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন এবং তাহনিক করতেন।’ (মুসলিম : ১০৬৯)
সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখা : অর্থবহ নাম হওয়া নামের সৌন্দর্য। মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে নামের মাধ্যমে। দুনিয়ার এ নামেই পরকালে তাকে ডাকা হবে। এ নামের প্রভাব পড়ে জীবন চলার পথে ও বংশের মধ্যে। রাসূল সা: বলেন : ‘তোমরা যখন আমার কাছে কোনো দূত পাঠাবে তখন সুন্দর চেহারা ও সুন্দর নামবিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাঠাবে।’ (তিরমিজি : ২৮৩৯)
ফলে মাতা-পিতার কর্তব্য হলো তার সন্তানের একটি অর্থবহ নাম রাখা। মহানবী (সা.) অর্থবহ নয় এমন অনেক নাম পরিবর্তন করেছেন। যেমন আবদুল ওজ্জা নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন আবদুল্লাহ, আসিয়া নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন জামিলা, বুররা নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘জয়নব’। ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহ.) বলেন, তাঁর পিতা একদা মহানবী (সা.)-এর দরবারে আসেন। রাসুল (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘হাজন’ (শক্ত)। মহানবী (সা.) এ নাম পরিবর্তন করে সাহল (সহজ) রাখতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পিতা আমার যে নাম রেখেছেন তা পরিবর্তন করবো না। মুসাইয়্যিব (রহ.) বলেন, এর পর থেকে আমাদের পরিবারে সদা কঠিন অবস্থা ও পেরেশানি লেগে থাকত (সহিহ বুখারি, মিশকাত পৃষ্ঠা-৪০৯)। উত্তম হলো আল্লাহর গুণবাচক নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নাম রাখা। যেমন আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান ইত্যাদি। মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় নাম হলো আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান। বালিকাদের জন্য উত্তম হলো আমাতুল্লাহ, আমাতুর রহমান ইত্যাদি নাম রাখা।
আকিকা ও সদাকাহ করা : পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে নবজাতকের দেহের ময়লা পরিষ্কার করা, চুল কাটা, চুলের ওজনের সমপরিমাণ রুপা দান এবং সন্তান লাভের শুকরিয়া হিসেবে আকিকা করা। আর এটি সুন্নাহ। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, “রাসুলুল্লাহ স. হাসান রা. পক্ষ থেকে ১টি বকরী আকীকা দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে ফাতেমা ! তার মাথা মুন্ডন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদাকাহ কর।” (সুনান আত-তিরমিযী ১৫১৯) মহানবী (সা.) বলেন, প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সঙ্গে বন্ধক থাকে। সুতরাং তার জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করবে, মাথার চুল মুন্ডন করবে ও নাম রাখবে। রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ছেলের জন্য দুটি ছাগল এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল আকিকা করবে (বায়হাকি)।
খাতনা করানো : মাতা-পিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো যথাসময়ে পুত্রসন্তানের খাতনার ব্যবস্থা করা। এটি সুন্নতে ইবরাহিমি এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। হযরত ইবরাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে নিজের খাতনা নিজে করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, স্বভাবসম্মত কাজ পাঁচটি। তার মধ্যে একটি হলো খাতনা। হাদীসে এসেছে, জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. হাসান এবং হুসাইন রা. এর সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন।” [আল-মু‘জামুল আওসাত, হদিস নং-৬৭০৮] উল্লেখ্য যে, খাতনা উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদি করার কোনো অনুমতি হাদিসে পাওয়া যায় না।
তাওহীদ ও রিসালত শিক্ষা দেয়া : শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর একত্ববাদ ও নবীর রিসালত শিক্ষা দিতে হবে। আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, বৃষ্টিতে যে মহান শক্তির হাত তা শুনিয়ে সুকৌশলে তিলে তিলে তার কোমল হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভীতির বীজ বপন করা একান্ত প্রয়োজন। সন্তান যখন কথাবার্তা বলতে শেখে তখনই তাকে কালেমা শিক্ষা দিতে হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ স. বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বারা কথা শুরু করাও এবং মৃত্যুর সময়ও এর তালকিন দাও।’ (বায়হাকি)।
প্রিয় নবী স. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে লক্ষ্য করে বলেন, হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। যখন কোন কিছু চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সহযোগিতা চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সক্ষম হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে।
কুরআনুল কারীম শিক্ষা দেয়া : মাতা-পিতার প্রধান দায়িত্ব হলো স্বীয় সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা দান করা। মহানবী (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। (ইবন মাজাহ, বায়হাকি, মিশকাত পৃষ্ঠা ৩৪) হযরত আলী রা. বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও।” [জামিউল কাবীর]
কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। হযরত উসমান রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ স. ইরশাদ, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ [সহিহ বুখারি-৫০২৭] অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের সন্তানকে কুরআন শরীফ নাজেরা পড়ায়, তার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর যে সন্তানকে হাফেজ বানাবে, তাকে হাশরের ময়দানে পূর্নিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল করে উঠানো হবে, এবং তার সন্তানকে বলা হবে পড়তে শুরু কর। সন্তান যখন একটি আয়াত পড়বে, তখন পিতার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এ ভাবে সমস্ত কুরআন পড়া হবে এবং মাতা-পিতার মর্যাদাও শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন