সালাত শিক্ষা দেয়া ও তা আদায়ে অভ্যস্থ করা : মাতা-পিতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি ইবাদতে অভ্যস্থ করা। তাছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, অপরকে সালাম দেওয়া এবং সুন্নত তরিকা মোতাবেক চলার প্রশিক্ষণ দেওয়া। মহানবী (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছর হয়, তখন নামাজ পড়ার তাগিদ দাও এবং যখন ১০ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন নামাজ পড়ার জন্য শাসন করো। আর তখন তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। (আবু দাউদ ৪৯৫, মিশকাত পৃষ্ঠা-৫৮)। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিজের পরিবার-পরিজনকে নামাজের আদেশ দাও এবং তাতে অবিচল থাকো।’ (সুরা : ত্বহা: ১৩২)
আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া : আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারাই হবে দেশ ও জাতির কর্ণধার। তারা যদি হয় নম্র, ভদ্র, নীতিবান ও চরিত্রবান তবে গোটা সমাজই হবে নীতিবান ও চরিত্রবান। তাই ছোট সময়েই তাদের এভাবে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস। অর্থাৎ ছোট সময় আদব-কায়দা ঠিক করতে না পারলে বড় হলে ঠিক করা যাবে না। তাই সন্তানকে নম্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া মাতা-পিতার প্রধান দায়িত্ব। মহানবী (সা.) বলেছেন, পিতা স্বীয় সন্তানকে শিষ্টাচার অপেক্ষা উত্তম কিছু শিক্ষা দিতে পারে না। (তিরমিজি, মিশকাত পৃষ্ঠা-৪২৩)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : তোমরা নিজেদের ও পরিবার পরিজনদের আল্লাহভীতির ব্যাপারে উপদেশ দাও এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (বুখারি : ২৮১) ওমর রা: জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন : ‘তোমার সন্তানকে আদব শিক্ষা দাও। কারণ তুমি তোমার সন্তানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে যে, তুমি তাকে কী আদব শিখিয়েছ, তুমি তাকে কী শিক্ষাদান করেছ? (বায়হাকি : ৪৮৭৭) লুকমান আ. তার সন্তানকে বললেন, ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।” [সূরা লুকমান, ১৮-১৯।]
আদর-স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া : সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা প্রিয়নবীর সুন্নাহ। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ স. হাসান ইবনে আলী রা. কে চুমা দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় আকরা ইবনে হাবিস রা. ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমারতো দশটি সন্তান কিন্তু আমিতো কখনো আমার সন্তানদেরকে আদর স্নেহ করিনি। রাসুলুল্লাহ স. তার দিকে তাকালেন এবং তার কথা শুনে বললেন, আমার কী ক্ষমতা! যদি আল্লাহ তোমাদের অন্তর থেকে দয়া-মায়া উঠিয়ে নেন ।” [সহিহ বুখারি -৫৯৯৭]
প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা : সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করা মাতা-পিতার অপরিহার্য কর্তব্য। উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম স. কে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? নবীজি স. বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে। [সহিহ বুখারি-৫৩৬৯] সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা, রোগমুক্ত রাখা স্বাস্থ্যবান হিসেবে গড়ে তোলা এবং জীবনের উন্নতি ও বিকাশকল্পে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালানো মাতা-পিতার কর্তব্য। তার পুষ্টিকর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানিসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা আবশ্যক। হযরত আনাস (রা.) বলেছেন আল্লাহ আমার মাকে জাজায়ে খায়ের দান করুন। তিনি আমার লালন-পালন ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সক্ষম করে তোলা : সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী স. আমাকে এভাবে বলেছেন- “তোমাদের সন্তান সন্তুতিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।” [সহিহ বুখারি-১২৯৫]
বিবাহ দেয়া এবং বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা কন্যাকে আশ্রয় দেয়া: সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে বিবাহ দেয়া পিতার দায়িত্ব। সন্তান যখন যৌবনে পদার্পন করে তখন তার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটে, তখন সে নতুন কিছুর সন্ধানে উন্মুখ হয়। সে যেকোন সময় বিপদগামী হতে পারে। তাই পিতার একান্ত উচিৎ উপযুক্ত পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। মহানবী (সা.) তিনটি কাজ দ্রুত করতে বলেছেন ১. ওয়াক্ত হলে নামাজ পড়া ২. ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ের ব্যবস্থা করা ৩. জানাজা উপস্থিত হলে জানাজা পড়া। (তিরমিজি ও মিশকাত) বিবাহ মানুষকে পাপ কাজ হতে বিরত রাখে। রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন, বিবাহ দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। হযরত আবূ হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই পিতার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। কোন কারণে কন্যা যদি স্বামী কর্তৃক পরিত্যাক্তা হয় কিংবা বিধবা বা অসহায় হয়ে পড়ে, তখন পিতা সেই ভাগ্যাহতা কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, আশ্রয় ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে। কোন অবস্থাতেই পিতা তার ব্যাপারে বিমুখ হবে না। সন্তানের এ অধিকার পিতার নিকট প্রাপ্য।
সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা : সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ সা: এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেছেন : ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করো। (বুখারি :২৫৮৭)
ইসলাম বিবর্জিত কাজ থেকে বিরত রাখা : আমরা অনেক সময় ব্যক্তিগত রাগ বা জাগতিক ক্ষতির কারণে সন্তানদের শাসন করি অথচ ধর্মীয় ও নৈতিক আচরণের ত্রুটিগুলোর ব্যাপারে উদাসীন থাকি। রাসুলুল্লাহ স. ও তাঁর সাহাবিরা এর উল্টো করেছেন। জাগতিক বিষয়াদির ক্ষতি, কষ্ট বা ব্যক্তিগত রাগ সহ্য করলেও দ্বীনি বিষয়ের অবহেলায় কঠোর শাসন করেছেন। আপনিই আপনার সন্তানের প্রথম আদর্শ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন