২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলের গাড়ি বহরে বন্দুকধারী সন্ত্রাসীদের হামলার পর দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়নি। একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে নিজেদের দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না দেখে। যখন নিরাপত্তার শঙ্কা কেটে যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে পাকিস্তান সফর করছিল বিভিন্ন দেশ, ঠিক তখনই নিরাপত্তার ঠুনকো অজুহাতে সফর বাতিল করে পাকিস্তান ছেড়ে গেছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গতপরশু রাতে সেই একই কারণ দেখিয়ে নারী ও পুরুষ দলের নির্ধারিত পাকিস্তান সফর বাতিল করেছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডও। তাতেই রাগ, ক্ষোভ ও বিষাদে ডুবেছে পাকিস্তান ক্রিকেট। এভাবে সফর বাতিল করায় নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক রথি-মহারথিরাও। তবে মাত্র একটি শব্দে এর সময়োপযোগী ও যুৎসই উত্তর বুঝি খুঁজে পেয়েছেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও সাবেক অধিনায়ক রামজ রাজা- ‘ওয়েস্টার্ন ব্লক’।
কিছুদিন আগেও একতরফা ভাবে বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করতো ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া। এক নামে যাদের বোঝানো হতো ‘বিগ থ্রি’ নাতে। তাদের স্বেচ্ছাচারি আর হঠকারী মনোভাবে ধ্বংস হতে বসেছিল বিশ্ব ক্রিকেটের ভাবমর্যাদা, জেন্টেলম্যানস গেম ক্রিকেটের স্বকীয়তা। এর জেরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি’র সভাপতি পদ থেকেও পদত্যগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বাংলাদেশের গর্ব বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আরো স্পষ্ট করে বললে, আইসিসির তৎকালীন ভারতীয় চেয়ারম্যান এন শ্রী নিবাসনের সেচ্ছাচারিতার জবাব দিতেই স্বেচ্ছায় পদত্যগ করেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সাবেক সফল প্রেসিডেন্ট এই লোটাস কামাল। তার পর একে একে এই ‘বিগ থ্রি’র বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে থাকেন আইসিসির সুবিধা থেকে বঞ্চিত অন্য দেশের বোর্ডও। আর তাতে থুব বেশিদিন তিন মোড়লের রাজত্ব টেকেনি। এবার এ যেন ‘নতুন মোড়কে পুরনো মদের’ মতো সেই ‘বিগ থ্রি’রই নতুন করে আবির্ভাব!
পিসিবি প্রেসিডেন্ট রমিজ রাজার এক ভিডিও বার্তাকে কেন্দ্র করে তথ্যনির্ভর এক খবর ছেপেছে ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। যেখানে দেশটির সাবেক এই অধিনায়ককে বলতে শোনা গেছে, নিউজিল্যান্ডের সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর হয়ে এলেও ইংল্যান্ডের সফর বাতিল করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিতই ছিল! হতাশা ও ক্ষোভ অবশ্য কম নয় তার, বরং বেড়েছে আরও। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) চেয়ারম্যানের দাবি, ক্রিকেটের ওয়েস্টার্ন ব্লক একজোট হয়ে পাকিস্তানকে বিপাকে ফেলার আয়োজন করছে। ইংলিশ বোর্ড তাদের বিবৃতিতে নিরাপত্তা শঙ্কার কথা সরাসরি উল্লেখ করেনি। বরং তারা বলেছে এই অঞ্চলে ভ্রমণ নিয়ে দুর্ভাবনা ও কোভিড পরিস্থিতিতে ক্রিকেটারদের মানসিক চাপ না বাড়ানো। এটিই পিসিবি কর্তাদের ক্ষুব্ধ করেছে আরও। মহামারী শুরুর পর এর মধ্যেই দুই দফায় ইংল্যান্ড সফর করে এসেছে পাকিস্তান। কিন্তু প্রাপ্য প্রতিদান থেকে তাদের বঞ্চিত করা হলো বলে মনে করছে পিসিবি। ভিডিও বার্তায় সেই ক্ষোভই উগড়ে দিলেন রমিজ রাজা, ‘ইংল্যান্ড সফর বাতিল করায় আমি ভীষণ হতাশ, তবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওয়েস্টার্ন ব্লক এসব ক্ষেত্রে একজোট হয়ে পরস্পরের পাশে থাকে। নিরাপত্তা হুমকি ও শঙ্কার কথা বলে আসলে যে কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া যায়। আমাদেরক্ষুব্ধ হওয়ার একটা কারণ, নিরাপত্তা শঙ্কার ধরণ নিয়ে কোনো তথ্য নিউজিল্যান্ড আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেনি। এরপর ইংল্যান্ডের ঘোষণা অনুমিতই ছিল, কারণ ওয়েস্টার্ন ব্লক এসবই করে। আমাদের জন্য এটা শিক্ষা। আমরা তাদেরকে সেবা দিতে নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে চেষ্টা করি, তাদের চাওয়াকে মাথায় তুলে রাখি। আমরা দুনিয়ার সেরা অতিথিপরায়ণ। অথচ আমরা ওদের দেশে গিয়ে কোয়ারেন্টিনের সব নিয়ম মানি, অনেক অপমান করা হলেও সহ্য করি। এখানেই শিক্ষা নেওয়ার আছে যে, এখন থেকে আমরা ততটাই করব, যতটায় আমাদের লাভ আছে।’
রমিজ পিসিবি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এমন বড় দুটি ধাক্কা হজম করতে হচ্ছে পাকিস্তানের ক্রিকেটকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবার একঘরে হয়ে পড়ার শঙ্কা তো আছেই, পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে প্রচুর। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দেড় থেকে আড়াই কোটি মার্কিন ডলার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পিসিবি। রমিজের আশঙ্কা, এই দুই সিরিজ বাতিলের প্রভাব অন্যান্য সিরিজের ওপরও পড়তে পারে, ‘ক্রিকেট সমাজ যদি এসবের খেয়াল না রাখে, তাহলে আর কী লাভ! বিপদের সময়ই তো পরস্পরের পাশে থাকা উচিত। নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফর বাতিল করল, সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ, অস্ট্রেলিয়া-এসবও হুমকিতে পড়তে পারে। কারণ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের ব্লক একই। অভিযোগ কাকে করবো? তারা তো আপন। যদিও তারা আমাদের আপন করেনি এবং নানা অজুহাত খোঁজে সফর না করার।’
এই কথার রেশ টেনে নিউজিল্যান্ডের কাছ থেকে ‘ক্ষতিপূরণ’ আদায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বলেও জানান রমিজ। তবে সেটা আর্থিক নাকি নতুন সিরিজ আয়োজন, সেসবের বিস্তারিত তিনি জানাননি। বিশ্বকাপের আগে পরপর দুটি সিরিজ বাতিল হওয়ায় পাকিস্তানের প্রস্তুতিতেও বেশ চোট লেগেছে। সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে শ্রীলঙ্কা কিংবা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সারির দলের সঙ্গে সিরিজের কথাও পাকিস্তান ভেবেছিল বলে জানান রমিজ। তার দাবি, এই দুই দেশ তৈরিই ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাড়াহুড়োর পথ তারা বেছে নেননি বলে জানান তিনি। এরই মাঝে কিছুটা সুর নরম করতে বাধ্য হয়েছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের (এনজেডসি)। তাদের প্রধান নির্বাহী ডেভিড হোয়াইট বাতিল হওয়া পাকিস্তান সফরের সূচি ভবিষ্যতে পুনঃর্নিধারণ করে খেলার ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করেছে, ‘পাকিস্তান ক্রিকেটের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগামী কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাসখানেক এ নিয়ে কাজ করে আমরা বাতিল হওয়া সফরের খেলা নিশ্চিত করতে চাই। এ (পাকিস্তান সফর) নিয়ে এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আগেভাগেই বলা হয়ে যায়। আমরা প্রতিটি সফরের গুণাগুণ যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেব।’
তবে তার ভবিষ্যৎ কিছুটা আঁচ করতে পেরেই কি-না পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে কোনো ‘হোম সিরিজ’ খেলবে না পাকিস্তান। পিসিবির এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ড সিরিজ খেলতে চাইলে পাকিস্তানেই আসতে হবে। ক্রিকউইককে সেই মুখপাত্র বলেন, ‘পিসিবি পরিষ্কার জানিয়েছে, পাকিস্তান বিদেশে কোনো হোম সিরিজ খেলবে না। নিউজিল্যান্ড খেলতে চাইলে তাদেরকে পাকিস্তানে আসতে হবে। এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যস্ত সূচি রয়েছে পাকিস্তানের। তাই নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলার সুযোগ নেই।’
এই কথার যুক্তিতে ইংল্যান্ড-ভারতের ম্যানচেস্টারে ৫ম টেস্টকে উদাহরণ হিসেবে টেনে রমিজ বলেন, ‘এইতো ক’দিন আগেই ইংল্যান্ড সফর শেষ না করেই কোভিড সংক্রমণের দোহাই দিয়ে ম্যাচ বাতিল করেছে ভারত। অথচ পরের দিনের পিসিআর পরীক্ষাতেই নেগেটিভ হয়েছিলেন কোচ রবি শাস্ত্রীসহ বাকিরা। তবুও ইংল্যান্ডের আপত্তি সত্বেও ভারত ম্যাচটি খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। আর তাতে ইসিবির ক্ষতি প্রায় ৪ কোটি পাউন্ড। পরে এ নিয়ে আইসিসির দরবারে যাবার প্রস্তুতিও চালিয়েছিলে ইসিবি। তবে আমরা সেদিকে যাবো না, কেননা আমরা ক্রিকেটের জবাব ক্রিকেট দিয়েই দিতে জানি। সম্পর্ক খারাপ করে নয়।’
আপাতত রমিজের চাওয়া, বিশ্বকাপে মাঠের ক্রিকেটেই যেন জবাব দেয় পাকিস্তান, ‘আমরা বিশ্বকাপে যাব এবং সেখানে আগে লক্ষ্য ছিল একটি দল, আমাদের প্রতিবেশিরা (চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত), সেখানে এখন আরও দুটি দল যুক্ত হলো-নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। এখান থেকে শক্তিও মিলবে এবং একটা মানসিকতাও গড়ে তুলতে হবে যে, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে ঠিক কাজ করোনি, আমরা তোমাদের কাছে হারব না।’ মাঠের ক্রিকেটেই প্রতিশোধ নিতে হবে।’ আগামী মাসের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের গ্রুপেই আছে ভারত ও নিউজিল্যান্ড। সবকিছু ঠিক থাকলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে দেখা হতে পারে কেবল সেমি-ফাইনাল বা ফাইনালে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন