মাওলানা আবদুর রাজ্জাক
॥ এক ॥
দা’ওয়াত শব্দের অর্থ ডাকা, আহ্বান করা। যে ডাকে তাকে দায়ী বলা হয়। আর যাকে ডাকা হয় সে হল মাদউ। দা’ওয়াতের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর পথে আহ্বান করা। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “(হে নবী) বলে দাও, এই আমার পথ, আমিও পরিপূর্ণ উপলব্ধির সাথে আল্লাহর দিকে ডাকি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তারাও। আল্লাহ (সব রকম) শিরক থেকে পবিত্র। যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়”(সূরা ইউসুফ-১০৮)
আল্লাহর পথে আহ্বান করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বান করা। দীন কী? দীন হলো ইসলাম। মহান প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ হতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) যা নিয়ে এসেছেন সেটাই দীন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্য) দীন কেবল ইসলামই” (সূরা আলে ইমরান-১৯)
সুতরাং ইসলামই হলো দাওয়াতের মূল আলোচ্য বিষয়। আর এটাই হলো দাওয়াতের প্রথম মূলনীতি এবং রাসূলে কারীম (সা.) এই মর্যাদাপূর্ণ ধর্ম ইসলামেরই দা’ওয়াত পরিপূর্ণ ও সুচারু রূপে পৌঁছিয়েছেন। তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছিলেন, রেসালাত লাভে ধন্য হওয়ার পর থেকে মহিয়ান মালিকের সান্নিধ্যে ফিরে যাবার পূর্বসময় পর্যন্ত। আর এজন্যেই আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “হে নবী! আমিতো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে এবং আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও আলো বিস্তারকারী প্রদীপরূপে” (সূরা আহ্যাব-৪৫,৪৬)
সুতরাং রাসূল (সা.)-ই হলেন ইসলামের সর্বপ্রথম দায়ী, ইসলামের দিকে সর্বপ্রথম আহ্বানকারী। অতএব দাওয়াতের মূলনীতি হলো দায়ী। বিশ্বনবী (সা.) আরব-অনারব সকলকেই ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন এবং প্রত্যেকেরই নিকট তার রেসালতের দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন। কেননা তার রেসালত শুধু আরব জগতে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এর ব্যাপকতা ছিল সমগ্র মানব জাহানে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “এবং (হে নবী) আমি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্য এমন রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি যে, আপনি সুসংবাদও শুনাবেন এবং সতর্কও করবেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝছে না” (সূরা সাবা-২৮)
সুতরাং মাদউ হলো (যাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা হবে) দাওয়াতে দীনের তৃতীয় মূলনীতি। রাসূল (সা.) ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সকল মাধ্যম, পথ এবং পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন; যেসব পথ ও পদ্ধতি আল্লাহ তাআ’লা ওহী’র মাধ্যমে রাসূল (সা.)-এর নিকট পাঠিয়েছেন; যেগুলো কোরআন ও সুন্নাতে বিদ্যমান, সেসব পথ ও পদ্ধতি, মাধ্যম ও তৎসম্পর্কিত বিষয়াদি হল দাওয়াতে দীনের চতুর্থ নাম্বার মূলনীতি।
দাওয়াতে দীনের মূলনীতি চারটি
(১) আলোচ্য বিষয়, (২) দায়ী, (৩) মাদউ (৪) দাওয়াতে দীনের মাধ্যম, পথ ও পদ্ধতি।
দাওয়াতে দীনের প্রথম মূলনীতি ‘আলোচ্য বিষয়’
দা’ওয়াতের আলোচ্য বিষয় হল ‘ইসলাম’।
ইসলাম কী? ইসলামের যতগুলো সংজ্ঞা রয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা যা হাদীসে জিবরাঈলের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর প্রশ্নের জবাবে বলেছেন “ইসলাম হলো, তুমি মুখে ও অন্তরে এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতিত কোন ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। জাকাত দিবে। রমজানের রোজা রাখবে এবং সামর্থ্য হলে হজ্ব করবে।
ইসলামের রুকন : উপরোল্লিখিত হাদীসের ভিত্তিতে ইসলামের রুকন তিনটি-
(১) এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।
(২) এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।
(৩) আমলে সালেহ্ তথা নেক আমল। আর নেক আমলের শাখা হল নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি।
এ চারটি উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, এগুলোর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অন্যান্য আমলের চেয়ে বেশি। এসব আমলে সালেহ্ এর কথা উল্লেখ করার এটাও একটি কারণ যে, মুসলমানদের জন্য আমলে সালেহ করা অপরিহার্য বিষয়। এটা যাতে মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাসে থাকে। শুধু দু’টি বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়াই যথেষ্ট নয় বরং এ দু’টি সাক্ষ্যদানের মূল বিষয়বস্তুর উপর আমল করাও মুসলমান হওয়ার জন্য জরুরি বিষয়।
প্রথম রুকনের দাবি : আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই অর্থাৎ কোন মা’বুদ বা উপাস্য নেই। দাসত্ব শুধুই আল্লাহ তা’আলারই করা যাবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে কারো আনুগত্য বা দাসত্ব করা যাবে না। একমাত্র আল্লাহকেই রব মানতে হবে অন্য কাউকে রব মানা যাবে না।
ইসলামের দ্বিতীয় রুকনের দাবি হলো, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা, এ কথার প্রকাশ করা এবং বক্তব্যে ও কর্মে এর বর্ণনা দেয়া। বক্তব্যের মাধ্যমে বর্ণনা দেয়ার অর্থ হলো, মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া। আর কর্মে বর্ণনা দেয়ার অর্থ হলো, মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা.) এর আনিত নিয়ম-নীতি এবং পথ ও পদ্ধতির বাস্তবায়ন ঘটানো।
দ্বিতীয় রুকনের দাবি : মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তাআ’লার নবী এবং রাসূল। এ কথার উপর ঈমান আনার দাবি হলো, তিনি যা নিয়ে এসেছেন এবং যেসব সংবাদ প্রদান করেছেন সেগুলোর উপর নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা। যেসব বিষয় তিনি নির্দেশ করেছেন বা নিষেধ করেছেন সেসব বিষয়ের সত্যায়ন ও অনুসরণ করা কোন ধরনের সংকীর্ণতা, বাদানুবাদ এবং পশ্চাৎপরায়ণতা ব্যতিত। এমনকি এসব বিষয়ের কিছু অংশ গ্রহণ আর কিছু বর্জন করা এটাও হতে পারে না। কেননা এটা মুহাম্মদ (সা.) কে নবী-রাসূল হিসাবে বিশ্বাস করার যে দাবি তার পরিপন্থি। এ জন্য কোরআনী আয়াত এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বর্ণনা পেশ করেছে “এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমাদের প্রতি রহমতের আচারণ করা হয়”
(সূরা আলে ইমরান-১৩২)।
“(হে নবী!) মানুষকে বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের খাতিরে তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। বলে দাও, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তারপরও যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ কাফিরদেরকে পছন্দ করেন না”
(আলে ইমরান-৩১,৩২)
“যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করল” (সূরা নিসা-৮০)।
“মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রাসূল তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন, তখন তাদের কথা যেন কেবল এটাই হয় যে, তারা বলে আমরা (তার হুকুম) শুনলাম এবং মেনে নিলাম। আর তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তার অবাধ্যতা পরিহার করে চলে, তারাই কৃতকার্জ হয়”।
(সূরা নূর-৫১,৫২)
“(যুদ্ধ না করাতে) অন্ধের জন্য কোন গোনাহ নেই, খোঁড়া ব্যক্তির জন্য কোন গোনাহ নেই এবং রুগ্ন ব্যক্তির জন্যও কোন গোনাহ নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে দাখিল করবেন জান্নাতে যার তলদেশে প্রবহমান থাকবে নহর আর যে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিবে তাকে যন্ত্রণাময় শাস্তি দেবেন”(সূরা ফাতাহ-১৭)।
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা গ্রহণ কর। আর তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় করে চল। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা” (সূরা হাশর-৭)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন