মাওলানা আবদুর রাজ্জাক
॥ তিন ॥
দায়ী আল্লাহর পথে ডাকবে সবসময়-সর্বাবস্থায় : নামাজ, রোজা, হজ্জ ইত্যাদির মত দওয়াতের নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা নেই। দায়ী তার উপর অর্পিত এ ফরজ দায়িত্ব পালন সর্বদা-সর্বাবস্থায়। আল্লাহ তাআ’লা কালামে পাকে হযরত নূহ (আ.)-এর দাওয়াতের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে, হযরত নূহ (আ.) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার সম্প্রদায়কে রাত-দিন (সত্যের দিকে) ডেকেছি” (সূরা নূহ-৫)।
দায়ীর প্রতিদান আল্লাহর
কাছে বান্দার কাছে নয়
আল্লাহর পথে আহ্বানকারী স্বীয় ফরজ দায়িত্ব পালন করে এবং আল্লাহর আনুগত্য প্রদর্শন করে। তাই আবিদ তার ইবাদতের প্রতিদান প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ হতে অনুগ্রহ হিসেবে পাবে। একারণে দায়ী কোন মাখলুক থেকে প্রতিদান চাইতে পারে না, চাই সেটা সম্পদ হোক, সুনাম হোক, পদমর্যাদা হোক পার্থিব কিংবা আত্মিক হোক। আল্লাহ তাআ’লা নূহ (আ.)-এর ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন “তথাপি তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে এর (অর্থাৎ এই প্রচার কার্জের) বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনি। আমার পারিশ্রমিক অন্য কেউ নয়; কেবল আল্লাহই নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। আর আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে আমি যেন অনুগত লোকদের মধ্যে শামিল থাকি” (সূরা ইউনূস-৭২)। আর আমাদের নবী (সা.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন “হে নবী! বলে দাও, আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা, আত্মিয়ের সোহার্দ ছাড়া (সূরা শূরা-২৩)। প্রত্যেক নবী-রাসূলদের নিয়ম ছিল, তারা দাওয়াতের বিনিময় কোন মাখলুখ থেকে চাইতেন না। সূরা ইয়াসিনে আল্লাহ বলেন “শহরের প্রত্যেক অঞ্চল থেকে এক ব্যক্তি ছুটে আসল। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসূলগণের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চায় না এবং যারা সঠিক পথে আছে”।
দাওয়াতের কাজ করতেই থাকবে
যদিও কেউ গ্রহণ না করে
ইমাম নববী বলেন “দাওয়াতের দায়িত্ব থেকে দায়িত্বশীল কখনও অব্যহতি পাবে না যদিও তার ধারণা হয় দাওয়াতের দ্বারা কোন কাজ হবে না। আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন “তুমি উপদেশ দিতে থাক কেননা উপদেশ ঈমানদারদের কাজে আসবে”। একজন মুসলমানের দায়িত্ব হল দাওয়াত দিতে থাকা, হিদায়াতের দায়িত্ব তার নয়। দায়ী দাওয়াত দিতে থাকবে। কোন রকম বিষণœœতা ছাড়া, নিরলশ ও ক্লান্তিহীনভাবে। কেননা তার উপর ফরজ হল পৌঁছানো এবং বয়ান করা। সে অন্যান্য ইবাদত যেমন করবে দাওয়াতও তেমন দিতে থাকবে।
দায়ীর মর্যাদা : ইসলামে আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর অনেক বড় সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “ওই ব্যক্তির আহ্বান অপেক্ষা উত্তম আহ্বান আর কার যে আল্লাহর পথে আহ্বান করে এবং সৎকর্ম করে এবং বলে আমি মুসলমানদের একজন”। মুফাস্সিরগণের নিকট আল্লাহর পথে আহ্বান করার বিষয় ব্যাপক। যে কোন ব্যক্তি যে কোন পন্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে সে উল্লেখিত প্রশংসা ও মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে। বাহ্যিক আমলের দিকে আহ্বান করুক বা বাতেনী আমলের দিকে। এ ফজিলত লাভ করতে পারবে। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি কোন মানুষকে হিদায়াতের পথে আহ্বান করবে তাকে সে বিনিময় দেয়া হবে যে বিনিময় আমলকারী ব্যক্তিকে দেয়া হবে। আর আমলকারী ব্যক্তির বিনিময় সামান্যও কমানো হবে না।
দায়ীর প্রস্তুতি : দায়ী তার দায়িত্ব পালনে প্রস্তুতির মুখাপেক্ষী। কারণ এটা এমন এক দায়িত্ব যা মূলত নবী-রাসূলের দায়িত্ব। দায়ীকে মজবুতভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। (ক) সুক্ষ্ম জ্ঞানের প্রস্তুতি (খ) দৃঢ় ঈমানের প্রস্তুতি (গ) আল্লাহ তাআ’লার সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক ও আল্লাহ নির্ভরশীলতার প্রস্তুতি। আমলের আগে ইলমের প্রস্তুতি নিতে হবে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “সুতরাং (হে রাসূল!) নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেহ নেই। আর ক্ষমা প্রার্থনা কর নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যও এবং মুসলিম নর-নারীর জন্যও” (সূরা মুহাম্মদ-১৯)। উক্ত আয়াতে আমলের আগে ইলমের কথা বলা হয়েছে। অতএব, আগে ইলম তারপর দাওয়াত।
সুক্ষ্ম জ্ঞানের রুকন দু’টি :
(১) জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের জ্ঞান এবং মানুষের মাঝে নিজ পজিসন বুঝার জ্ঞান।
(২) চলমান দুনিয়া থেকে দূরে থাকা, পরকালের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা। পৃথিবীতে মানুষ দু’প্রকার। এক প্রকার হল, যারা নিজ জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে অজ্ঞ। আর অন্য প্রকার হল যারা নিজ জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কের সচেতন। দায়ীকে হতে হবে জীবনের লক্ষ্যের প্রতি সজাগ। দুনিয়ার মোহ দায়ীর হৃদয়ে স্থান পেতে পারবে না।
দৃঢ় ঈমান : দায়ীকে একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমি মুসলমান আমার ধর্ম ইসলামই সত্য এবং সঠিক ধর্ম। এ ছাড়া অন্য সব মতবাদ, সব ধর্ম বাতিল ও ভ্রান্ত।
দৃঢ় ঈমানের রেজাল্ট তিনটি বস্তু :
(১) ভালোবাসা; ঈমানের দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে যাবে, বান্দা আল্লাহকে ভালোবাসবে, আল্লাহ বান্দাকে ভালোবাসবে। বান্দা যখন আল্লাহকে ভালোবাসবে তখন আল্লাহর সৃষ্টি মানুষকেও সে ভালোবসবে। একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই হয়ে যাবে। আর অমুসলিমদের প্রতি হবে সে কঠোর। যেমন সাহাবায়ে কিরাম দৃঢ় ঈমানের কারণে নিজেরা ছিলেন পরস্পর সদয় আর কাফেরদের বেলায় ছিলেন কঠোর।
(২) ভয়; দৃঢ় ঈমানের দ্বারা বান্দার অন্তরে আল্লাহর ভয় প্রতিষ্ঠিত হবে। যে ভয়ের কারণে কোন ধরনের পাপাচারে লিপ্ত হবে না এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না।
(৩) আশা; দৃঢ় ঈমান দ্বারা বান্দার অন্তরে আল্লাহর রহমতের প্রতি আশাবাদী হবে। আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য যেসব ওয়াদা ও সু-সংবাদ দান করেছেন, দৃঢ় ঈমানের কারণে বান্দা সেসব বিষয়ে আল্লাহর রহমতের পূর্ণ আশাবাদী হবে।
দা’য়ীর প্রস্তুতির তৃতীয় বিষয় হল আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ও আল্লাহর নির্ভরশীলতা
দা’য়ী যখন আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টিতে সক্ষম হবে এবং একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হবে তখন সে তার মিশনে সফল হতে পারবে।
দায়ীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : দায়ীর চরিত্র হতে হবে ইসলামী চরিত্র। কোরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত চরিত্রে দায়ীকে চরিত্রবান হতে হবে। দায়ীকে পাঁচটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে- (১) সত্যবাদীতা (২) ধৈর্যশীলতা (৩) অনুগ্রহশীল হওয়া (৪) বিনয়ী হওয়া (৫) মানুষের সংমিশ্রণ ও মানুষ থেকে দূরে থাকা।
দাওয়াতে দীনের তৃতীয় মূলনীতি হল ‘মাদউ’
যাকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা হয় তাকে মাদউ বলে।
মাদউর সজ্ঞা :
মাদউর শ্রেণী বিন্যাস-
মাদউ অর্থাৎ যাকে দীনের পথে আহ্বান করা হবে। মাদউ হল গোটা দুনিয়ার সব মানুষ। কেননা আল্লাহ প্রেরিত দীন ‘ইসলাম’। ইসলাম নিয়ে আল্লাহ তাআ’লা পাঠিয়েছেন মুহাম্মদ (সা.) কে দুনিয়ার সমগ্র মানুষের নিকট। আল্লাহ তাআ’লা বলেন “(হে রাসূল ! তাদেরকে) বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের নিকট প্রেরিত রাসূল”(সূরা আ’রাফ-১৫৮)। “ এবং আমি তোমাদের সমস্ত মানুষের জন্য এমন রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি যে সুসংবাদও শোনাবে এবং সতর্কও করবে” (সূরা সাবা-২৮)। আয়াতদ্বয়ে সব শ্রেণির মানুষকে মাদউ সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়ষ্ক, জ্ঞানী চাই সে যে বংশের, বর্ণের, পেশার, রাষ্ট্রের, পুরুষ হোক কিংবা মহিলা হোক। তাইতো রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছেন আরবি, হাবসি, রোমি, ফারসি, মহিলা, কিশোর, ধনী, গরীব যথা আবু বকর, বেলাল, সুহাইব, সালমান, খাদিজা, আলী বিন আবু তালেব, উসমান বিন আফ্ফান এবং আম্মার (রা.)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন