পুলিশী নির্যাতনে সিলেটে নিহত রায়হান আহমদের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো আজ (সোমবার)। নির্মম এ হত্যাকান্ডের একবছর পেরিয়ে গেলেও শুরু হয়নি এখনো বিচার কাজ। করোনা সংক্রমণ ভয়াবতার কবলে পড়ে এ মামলার কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে ধীর গতি। সর্বশেষ গেল ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত গ্রহণ করেছেন মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট)। এছাড়া এই ঘটনায় দায়ের করা পুলিশের বিভাগীয় মামলার তদন্তও শেষ হয়নি গত বছরেও। মামলা আর তদন্ত কার্যক্রমে এই ধীরগতিতে হতাশ রায়হানের পরিবার। এদিকে, এক বছর পূর্র্তির আগেরদিন গত রোববার বিকেলে রায়হানের মা ও স্ত্রী এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে পালন করেছেন এক মানববন্ধন কর্মসূচী। মানববন্ধনে অংশ গ্রহন করে রায়হানের দেড় বছর বয়সী শিশুকন্যা আলফাকেও। নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্টিত এ মানববন্ধনে অংশ নিয়ে রায়হান হত্যার বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্নের দাবি জানান রায়হানের মা সালমা বেগম ও স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। মানববন্ধনে বক্তৃতাকালে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও মামলার চার্জশিট দিতে অনেকে দেরি হয়েছে। এতে কিছুটা হতাশ আমরা। প্রয়োজনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা হস্তান্তর করে মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা হোক এবং আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। এসময় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বলেন, আমার স্বামীর খুনিদের সহায়তাকারী নোমান এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। সে যে দেশেই থাকুক না কেন, তাকে সে দেশের প্রশাসনের সহায়তায় দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক।
এদিকে, সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কতোয়ালী মডেল থাকার অর্ন্তগত বন্দরবাজার ফাঁড়িতে হেফাজতে রায়হান আহমদ হত্যা তোলপাড় করেছিল সারাদেশ। গেল বছরের ১০ অক্টোবর রাতে তুলে নিয়ে নগরর আখালিয়ার এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে ওই ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতন করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সংকটময় পরিস্থিতিতে তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। পরদিন ১১ অক্টোবর সকালে সিলেট ্ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান রায়হান। রায়হান সিলেট নগরের স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় এক চিকিৎসকের চেম্বারে সহকারি হিসেবে কাজ করতেন। রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা প্রথমে 'ছিতনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যু' বলে প্রচার করে পুলিশ। তবে রায়হানের পরিবার প্রথম থেকেই নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ তোলে হয়ে উঠে প্রতিবাদী। এরপই পেক্ষিতে সিলেট মহানগর পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে নামে, সেই তদন্তে প্রমাণ মিলে নির্যাতনে। এ হত্যা ঘটনায় ১২ অক্টোবর পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে সিলেট কতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী। এদিকে মামলার পর মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয় রায়হান পরিবারের পুলিশ নির্যাতন অভিযোগ তদন্তে। ওই কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। এ তদন্ত কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত এবং প্রত্যাহার করা হয় তিনজনকে। এরপর কনস্টেবল হারুনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। তবে প্রধান অভিযুক্ত আকবর ১৩ অক্টোবর পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। গত বছরের ৯ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে। এদিকে রায়হান স্ত্রীর তান্নির দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তে প্রথমে পুলিশ ছিল। পরে ১৩ অক্টোবর মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই)। কাছে।
২ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ
হত্যা ঘটনার সাত মাসের মাথায় গত ৫ মে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় আদালতে। অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার বাগইর গ্রামের মো. জাফর আলী ভুঁইয়ার পূত্র এসআই (সাময়িক বরখাস্ত) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করা হয়। হবিগঞ্জের মোহনপুরের মৃত আমির হোসেনের পূত্র দারোগা হাসান উদ্দিন (৩২), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চামারুল্লা গ্রামের মৃত আতাউল করিমের পূত্র এএসআই আশেকে এলাহী (৪৩), সিলেট বিয়ানীবাজার উক্তচন্দ্র গ্রামের অনিল কুমার দাসের পূত্র কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার একডালা গ্রামের আব্দুন নুরের পূত্র কনস্টেবল হারুনুর রশিদ (৩২)। এছাড়া অভিযুক্ত করা হয় এসআই আকবরের ‘বন্ধু’ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কথিত সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমানকে (৩২)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে। তবে মূল অভিযোগপত্র ২২ পৃষ্ঠার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয়েছে ৬৯ জনকে। এদিকে, আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা পরিস্থিতির কারণে চার মাস পর অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালতে। এরপর অভিযোগপত্র গঠনের শুনানির জন্য আদালত আগামী ২ নভেম্বর তারিখ ধার্য করেন। ওই দিন মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত একমাত্র আসামি আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
পর্তুগালে এসআই আকবরের বন্ধু নোমান:
রায়হান হত্যা মামলার সহযোগী এ চার্জশীট ভূক্ত আসামী কথিত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে, ঘটনার পর থেকেই পলাতক সে। এই অবস্থায় সর্বশেষ এখন পর্তুগালে অবস্থান করছে সে। সেখান থেকে বসে তার পাসপোর্ট বাংলাদেশে নবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র। তবে আগামী ২ নভেম্বর মামলার ধার্য তারিখে পলাতক আসামির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করার বিষয়টি উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে দালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) সৈয়দ শামীম আহমদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে অভিযোগপত্র দাখিল ও গ্রহনে বিলম্ব না হলে এত দিনে শুরু হতো বিচারকার্য।
একবছরেও শেষ হয়নি বিভাগীয় মামলার তদন্ত
সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পরপরই এস আই আকবর সহ পাঁচ পুলিশ ও সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবদুল বাতেনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হয় ৯টি বিভাগীয় মামলান। এ মামলার তদন্ত একবছরেও শেষ হয়নি। বিভাগীয় মামলাধীন ৯ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৫ জন রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এসআই আবদুল বাতেন, এএসআই কুতুব আলী ও দুজন কনস্টেবল সাময়িক বরখাস্ত আদেশে মহানগর পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত আছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পিআরবি (পুলিশ আইন) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কাজে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু-গুরু) বিধান আছে। গুরুদন্ডের আওতায় চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত। লঘুদন্ডে শুধু দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার বা পদাবনতি। বিভাগীয় মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গুরুদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন শুধু সাবেক ফাড়ি ইনচার্জ রায়হান হত্যা ঘটনার নায়ক আকবর।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ এব্যাপারে বলেন, পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কার্যক্রম ফৌজাদারি মামলার মধ্যে নেই। এর মাধ্যমে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আসছে, সেগুলো বিশ্লেষণ ও তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পুলিশ ও সাধারণ মানুষও রয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্যও নেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ বিভাগেই পাঠানো হবে। পরে বিভাগীয় আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে জড়িতদের ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন