মাহফুজুল হক আনার : দিনাজপুরসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত চালের দাম বেড়েই চলেছে। গত দু-মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম ৮ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মৌসুমের শুরুতে অত্যন্ত কম দামে ধান বিক্রি করে ঘর খালি করা কৃষকদের এখন দ্বিগুণ দামে চাল ক্রয় করে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে হচ্ছে। ধান-চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কারণ হিসেবে প্রশাসনের সুষ্ঠু মনিটরিং না থাকাই অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ইরি-বোরো’র ভরা মওসুম চললেও মজুতদারদের ঘরে এখনো আমন মৌসুমের হাজার হাজার বস্তা ধান মজুদ রয়েছে। সুযোগ সন্ধানী মজুদদারেরা বাজারে সংকট রেখে ইচ্ছেমত দামে ধান বিক্রি করছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কৃষক ও খেটে খাওয়া দিনান্তের মানুষেরা। এদিকে সরকারের হতদরিদ্র মানুষদের তালিকা করে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির মহতী উদ্যোগ কার্যত সুফল বয়ে আনতে পারছে না মাঠ পর্যায়ের স্বার্থান্বেষী জনপ্রতিনিধিদের কারণে। এক্ষেত্রে খোলা বাজারে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি অব্যাহত রাখলে খেটে খাওয়া মানুষেরা আরো বেশি উপকৃত হতো বলে ভুক্তভোগীরা মত প্রকাশ করেছে।
কৃষি বিভাগের মতে গত কয়েক বছর ধরে দিনাজপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে বাম্পার ফলন হয়েছে। তারপরেও ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণ কি। ইতিপূর্বে ভরা মৌসুমে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আসায় ধান-চালের বাজারে ধস নেমেছিল। কিন্তু এবার ভারত থেকে চাল আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে। তারপরও মৌসুমের শুরুতে প্রতি বস্তা ধান বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭ থেকে ৮শ’ টাকা দরে। এসময় অভাবি কৃষকদের ধান বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কৃষকের ঘরের ধান শেষ হওয়া মাত্র বাজারে ধানের দাম বাড়তে থাকে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে দাম হু হু করে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। কৃষকের ঘরের ধান শেষ হওয়ার পরপরই সরকার মিল মালিকদের কাছে সর্বোচ্চ দরে চাল ক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। ফলে বাজার হয়ে উঠে অস্থিতিশীল। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে কৃষকের ঘরে ধান না থাকলেও কম দামে ক্রয় করা হাজার হাজার বস্তা ধান এখনও মজুতদারদের গুদামে রয়েছে। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫’শ টাকা বস্তা। একইভাবে চালের দামও বেড়ে গেছে একই গতিতে। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে সকল ধরনের চাল প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়ে গেছে। দিনাজপুরে বর্তমানে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকা, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে এবার সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান ক্রয় করেছে। যদিও কৃষি বিভাগের তালিকা মোতাবেক কৃষকদের কাছে ধান ক্রয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জেলা ও থানা সদরের খাদ্য বিভাগে ধান ক্রয় করার কারণে প্রকৃত কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারেনি। মূলত ফড়িয়ারা কৃষকদের কার্ডে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রি করেছে। তদন্ত করলেই শত শত কৃষক পাওয়া যাবে যার নামে ধান দেয়া হয়েছে গোডাউনে সে কিছুই জানে না এ বিষয়ে। ফলে কৃষক অর্থের বিনিময়ে আগের মতোই ক্ষেতে এবং বাজারে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে।
একজন অটো মিল মালিক বললেন, চালের দাম বৃদ্ধি পেলেই দোষারোপ করা হয় মিল মালিকদের। মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় মজুদদারীর। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন, একটি অটো মিল চালু রাখতে কত টন বা মণ ধান প্রয়োজন এ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকাই অভিযোগ তোলার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যদি মিলের চাকা চালু না রাখা যায় তাহলে ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে। আর দু’মাস মিল চালু রাখলে যে পরিমাণ ধানের প্রয়োজন তা কোনো মিল মালিকের পক্ষে মজুদ করা সম্ভব নয়। এরপরও উৎপাদিত চাল বিক্রি করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা আড়তদারদের কাছে পড়ে থাকে।
এ বিষয়ে চাল কল মালিক গ্রæপের একজন প্রবীণ সদস্য বললেন, সরকারের খোঁজ নেয়া উচিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দিকে। সিসি ঋণের নামে কাদেরকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে। ট্রেড লাইসেন্সধারী মৌসুমী ব্যবসায়ীরা গুদাম চাতাল দেখিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গা জামানত দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মূলত মজুদদারীর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মৌসুমী এসব ব্যবসায়ীদের কাছে বড় বড় মিলাররাও জিম্মি হয়ে আছে। মিল চালানোর লক্ষ্যে মজুদদারদের ঘরের ধানই ভরসা। মজুতদারদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান ক্রয় করে চাল বানিয়ে তা বেশি দামেই বিক্রি করে মিলাররা। আর এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে মজুতদারী নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ব্যাংকের টাকায় খাদ্যশস্য মজুদের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা এবং তদারকি রাখতে হবে। না হলে যতই বাম্পার ফলন হোক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।
এদিকে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষক ও দিনমজুরেরা। কৃষকরা যখন ধান বিক্রি করেছে তখন ধান-চালের দাম ছিল সর্বনি¤œ পর্যায়ে। ইরি-বোরো সবুজ ধান গাছে ভরপুর হয়ে আছে উত্তরাঞ্চলের মাঠ। এসময়ে কৃষকের ঘর ধান-চাল শূন্য থাকে। মাঠেও কাজ নেই। এ অবস্থায় চালের দাম বৃদ্ধি কৃষক ও দিনমজুরদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা জানালেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তালিকা করে হতদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া হচ্ছে সোয়া দুই লক্ষ মানুষকে। নিঃসন্দেহে যা সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু খোলা বাজারে খাদ্য বিভাগের চাল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। খাদ্য বিভাগের ওএমএস ডিলাররা এখন আটা ছাড়া আর কিছুই বিক্রি করছে না। ফলে চরম বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া কৃষক-কৃষাণী ও দিনমজুরেরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন