বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ছয় বছরে নিহত ৪৩ হাজার ৮৫৬

নিরাপদ সড়ক দিবস আজ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

দুই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতি ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি


এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এখনো পরিকল্পনা নেই : বিশেষজ্ঞদের মত

দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ সড়কে প্রাণ দিচ্ছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মুহূর্তে কর্মক্ষম জনসম্পদ বা প্রাণগুলো হারিয়ে সংখ্যায় পরিণত হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিবছর দুর্ঘটনাজনিত কারণে বছরে দেশের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ হাজার ৩১৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। ১৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হচ্ছে।

সংখ্যা যাই হোক, সড়কে মৃত্যু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।

আর এ থেকে উত্তরণে দেশের বিভিন্নস্তরের জনসাধারণের মাঝে সড়ক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে প্রতিবছর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’। আজ শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁওস্থ সড়ক ভবন অডিটোরিয়ামে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পক্ষ থেকে সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী-সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। যদিও অন্যান্য দিবসের ন্যায় গতানুগতিকভাবে এই দিবসটি পালন করা হয়। তাই সড়কে প্রাণহানি বা ক্ষতি না কমে বরং বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদ সড়ক দিবসকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার সংক্রান্ত আলোচনা সভা, মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা সংক্রান্ত আলোচনাসহ দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে সমাজের সকল স্তরে নিরাপদ সড়কের বার্তা পৌঁছে দেয়া গেলে দিবসটি উদযাপনের সুফল পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) তে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা দশককে কেন্দ্র করে পৃথিবীর দেশে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এরই মধ্যে বহুদেশে সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাযথ কোনো পরিকল্পনা তৈরি করেনি। সড়ক নিরাপত্তায় যুক্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নেওয়া পরিকল্পনাগুলো ছিল গতানুগতিক। এর মাধ্যমে কী অর্জিত হয়েছে, আর কী অর্জিত হয়নি বা কী অর্জন করা প্রয়োজন, তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা নেই।

‘নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২১’ উপলক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ ছয় বছরে সারা দেশে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত এবং ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন। বিবৃতিতে নিরাপদ সড়কের জন্য সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নেরও দাবি জানান।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত, ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত; ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত, ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত; ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত, ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত; ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত, ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত; ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে মোজাম্মেল হল বলেন, জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।

এদিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সংলাপে গবেষণায় রিপোর্ট তুলে ধরে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর মো. হাদিউজ্জামান জানিয়েছেন, চলতি বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি জানিয়ে তিনি বলেছেন, এই টাকায় বেশ কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ (বিআই) ও ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টার (ডিটিসি) যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে।

প্রফেসর হাদিউজ্জামান বলেন, পুলিশের তথ্যমতে ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৯৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৪ হাজার ৩৫৮ জন। আহত হয়েছেন ৮ হাজার ২৪০ জন। ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি ৩৮ হাজার কোটি টাকা। যা আমাদের জিডিপির দেড় শতাংশ। ২০২০ সালে এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। তিনি বলেন, আমাদের সড়ক দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশ হয় অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসে। সড়কে কুয়াশা থাকার কারণে দুর্ঘটনাও বেড়ে যায়। এই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, চলতি বছরের সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি ২০১৯ কেও ছাড়িয়ে যাবে।
প্রফেসর মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বুয়েটের গবেষণা বলছে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ বছরের নিচে তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুহার বেশি। কারণ তরুণদের বেশিরভাগই মোটরসাইকেল আরোহী। আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিড্যান্টের সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অপার সম্ভাবনা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

গবেষণা বলছে, মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার পরিমাণ ২০১৯ সালে ছিল ২০ দশমিক ২ শতাংশ। সেটা এখন ২৩ শতাংশে চলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- ক্যান্সারের সেলের মতো এই যানের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। ২০১৬ সালে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ২০২০ সালে, সেটা ৩২ লাখে দাঁড়িয়েছে। ৪ বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা চারগুন বেড়েছে।
সংলাপে সভাপতির বক্তেব্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি সড়কে ২০০ অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা আছে, বাঁক আছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১২টা ঠিক করা হয়েছে। এগুলো ঠিক করতে মাত্র সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা লাগে। এগুলো সরকার দিতে পারে না; কিন্তু ব্যাংকগুলো থেকে হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়, সেই টাকা উদ্ধার করতে পারে না।

তিনি বলেন, এই স্পটগুলো ঠিক করলে সড়ক দুর্ঘটনা একবাক্যে ৪০ শতাংশ কমে যায়। সড়ক দুর্ঘটনার ১০৫টা কারণ আছে। মাত্র ৪টা কারণের জন্য দায়ী চালক। অথচ দুর্ঘটনা ঘটলে প্রমাণ না হওয়ার আগেই চালককে দোষী, ঘাতক বলা হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।

ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান নুরন্নবী শিমু বলেন, বিআরটিএ’র মাত্র ২০০ জন প্রশিক্ষক আছেন। সরকার ১৪০০ প্রশিক্ষক তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে ৮০০ প্রশিক্ষক তৈরি হয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী তাসমিমা বলেন, নারীদের সড়কে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। চালক, সহকারীদের তথ্য লিপিবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। আবার বাসগুলোর কাছ বিজ্ঞাপনে আচ্ছাদিত থাকে। এসব বিষয় সমাধানে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন মোটর ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল বাশার, ড্রাইভার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাদল আহমেদ প্রমুখ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন