কুমিল্লার নানুয়া দীঘিরপাড়ের অস্থায়ী পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন রাখা নিয়ে দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে হচ্ছে। নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দাবী, ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে তাকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কঠোর শাস্তি দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনার হোতাকে খুঁজে বের করতে অবিলম্বে তৎপর হয়ে ওঠে। অবশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইকবাল হোসেন নামে এক ভবঘুরেকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করেছে। পূজামন্ডপের আশপাশের এলাকার ক্লোজ সার্কিট টিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত হয়েছে ভবঘুরে ও মাদকাসক্ত ইকবাল হোসেনই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এ নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই ইকবাল সন্দেহভাজন আসল ইকবাল কিনা, এ প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক বলেছেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, আটক ব্যক্তিই কুমিল্লার ইকবাল। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য কুমিল্লায় পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দশগুপ্ত বলেছেন, ‘এটি কোনো ভবঘুরের কাজ হতে পারে না। এটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। চক্রান্তকারীরা পেছনে আছে। এদের বের করা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব।’
অতীতে রামুর বৌদ্ধ মন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনাসহ অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত কিংবা ঘটনার নেপথ্যের কুশীলবদের খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চললেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে তা অনেকটা ডিপফ্রিজে চলে গেছে। পর্যবেক্ষকরা সেটাকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে এবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত একজনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। এটা একটা অগ্রগতি। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যাকে ধরা হয়েছে, সে আসলেই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা? দ্বিতীয়ত, তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর যদি এটা প্রমানিত হয়, সত্যিই সে এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাহলে তার একার পক্ষে এ ঘটনা ঘটানো সম্ভব কিনা? কুমিল্লার হিন্দু সম্প্রদায়ের দুইজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ইকবালের নিজ থেকে ওই কাজ করার কোনো কারণ আছে বলে তারা মনে করেন না। রানা দাশগুপ্তর বক্তব্যের সঙ্গে তাদের বক্তব্যের সাদৃশ্য রয়েছে। তারা যে সন্দেহ করছেন, তা অমূলক নয়। কারণ, একজন ভবঘুরে ও মাদকাসক্তের পক্ষে একা একটি স্পর্শকাতর ও ঘোরতর অপরাধ ঘটানো সম্ভব নয়। এর পেছনে কোনো না কোনো চক্র রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করেছেন, আরেকটি জজ মিয়া কাণ্ড যেন না হয়। এর পেছনের ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। নেপথ্যের কুশীলবদের যদি খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না যায়, তবে দেশের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটতে থাকবে। অতীতের ঘটনাগুলোর সম্পৃক্তদের খুঁজে বের করতে না পারায় এবং পার পেয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, দেশকে আশান্ত করে তোলা, পারস্পরিক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার বিষয়টি এখন স্পষ্ট। এ ধরনের হীন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের গোয়েন্দাদের অনেক জটিল ও ক্লুলেস ঘটনা উদ্ঘাটনের সুখ্যাতি রয়েছে। কুমিল্লার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তারা একজনকে আটক করেছে। এখন তাদের দায়িত্ব প্রকৃত অর্থেই সে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা প্রমাণ করা এবং এর নেপথ্যে কারা রয়েছে তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ কাজ করা কঠিন কিছু নয়। তাদেরকে পেশাদারিত্বের সাথে নির্মোহভাবে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ঘটনার সাথে যে বা যারা জড়িত থাকুক, যত প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনের সম্পৃক্ততা থাকুক, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। গুরুতর এ ঘটনার তদন্ত এবং জড়িতদের গ্রেফতার যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় ও সন্দেহের কোনো অবকাশ না থাকে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে। অব্যাহত তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার মূলে গিয়ে নেপথ্যের চক্রান্তকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন