সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দেশটির ব্যবহারকারীদের পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণার জন্য ডামি অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির দুই কর্মকর্তা। এর জন্য তারা উত্তর ভারতের ২১ বছরের এক তরুণীর নামে প্রোফাইল তৈরি করেন। ওই অ্যাকাউন্টে ফেসবুক থেকে কী কী বার্তা আসে তা ট্র্যাক করেছিলেন তারা। অ্যাকাউন্টটি খোলার পরপর এর ফিডে পর্নো ছবি ও ভিডিও বার্তা আসতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় বিতর্কিত কাশ্মীরের সহিংসতা সংশ্লিষ্ট পোস্ট। ওই সময়ে কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তান সীমান্তে বিমান হামলা শুরু করেন। নির্বাচনী প্রচারসভাগুলোতে তিনি দাবি করতে শুরু করেন, সীমান্তে থাকা পাকসন্ত্রাসীদের শিবিরগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারকারীর কোনো নির্দেশনা ছাড়াই দ্রুত ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি মোদির পক্ষে প্রচারণা ও মুসলিম বিদ্বেষী মন্তব্য দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। একটি পোস্টে লেখা ছিল, ‘এই মাত্র ৩০০ কুকুর মারা গেছে, বলুন-ভারত দীর্ঘজীবী হোক, পাকিস্তান নিপাত যাক।’ আরেকটি পোস্টে সারি সারি লাশের ছবির নিচে লেখা ছিল, ‘এগুলো পাকিস্তানি কুত্তা।’ ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ নথি পর্যালোচনা করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ডামি অ্যাকাউন্টটি একটি ‘টানা দুঃস্বপ্নের রাত’ পরীক্ষা করেছিল, যেটি ভারতে ফেসবুকের অভিজ্ঞতা ও মার্কিন ব্যবহারকারীদের সাধারণত কী সম্মুখীন হয় তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্যকে তুলে ধরেছে। ফেসবুক পেপার্স নামে পরিচিত হওয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির এসব গোপন নথি সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন সংস্থাটির সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হগেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতেই সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত ফেসবুকের সদর দপ্তর থেকে আট হাজার মাইল দূরে উত্তর ভারতের একটি ছাত্রাবাসে অবস্থান করছিলেন জুনায়েদ নামের এক কাশ্মীরী শিক্ষার্থী। তিনি দেখছিলেন, তার ফেসবুক পেজ বিদ্বেষপূর্ণ বার্তা দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। তার পেজে শেয়ার হওয়া বার্তায় এক জন লিখেছিল, ‘কাশ্মীরীরা বিশ্বাসঘাতক, গুলিই তাদের প্রাপ্য।’ জুনায়েদের সহপাঠীদের কেউ কেউ এই বার্তাটি তাদের হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল ছবি হিসেবে রেখেছিলেন। জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম এই হোয়াটসঅ্যাপের মালিক ফেসবুকই। জুনায়েদ জানান, এক সন্ধ্যায় তিনি যখন তার কক্ষের ভেতরে ছিলেন তখন বাইরে কাশ্মীরীদের হত্যার দাবিতে মিছিল হচ্ছিল। রাস্তায় রাস্তায় কাশ্মীরীদের পেটানোর সংবাদ আসছিল তার ফোনে। একইসাথে তার ফেসবুক পেজে আরও সহিংস বার্তা আসছিল। তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে দাবানলের মতো বিদ্বেষ বার্তা ছড়াচ্ছিল। বিদ্বেষ ছড়ানো কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টই ব্লক করা হয়নি।’ ফেসবুকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার, মিথ্যা তথ্য প্রচার উত্তর আমেরিকায় যতটুকু রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এর মাত্রা নাটকীয়ভাবে আরও ভয়াবহ। ফেসবুকের প্রকাশিত গোপন নথিগুলোতে দেখা গেছে, এই বিষয়গুলো নিয়ে ফেসবুক বিদেশে সতর্কতার সাথে তাদের গবেষণা চালিয়েছে। ইংরেজি ভাষাভাষী নয়, এমন দেশগুলোতে দুর্বল মডারেশন প্ল্যাটফর্মটিকে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি ও কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অপব্যবহারের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। গত বছর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৫০ জনের বেশি নিহত হয়। এদের অধিকাংশ ছিল মুসলিম। ওই সময় মুসলিমদের ওপর সহিংসতা উস্কানি দেওয়ার প্রচুর ভিডিও ও ছবি পোস্ট হয়েছিল ফেসবুকে। এগুলোর অধিকাংশই ছিল ভুয়া। বিষয়টি ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানোর পরও তারা এসব ভিডিও ও ছবি সরিয়ে নেয়নি। বরং এগুলোতে ফ্যাক্ট চেক তকমা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন