স্কটিশ শহর গ্লাসগোতে শুরু হয়েছে বহুল প্রত্যাশিত কপ ২৬ জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষ সম্মেলন। গতকাল শুরু হওয়া এ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে ১৯৭টি দেশের প্রতিনিধিরা ২০৩০ সালের মধ্যে তারা কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমাবেন এবং পৃথিবী নামক গ্রহকে সাহায্য করবেন, তার ঘোষণা দেবেন। তার আগে শনিবার জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে বিশ্বনেতাদের চাপে ফেলতে গ্লাসগোতে বিক্ষোভ–সমাবেশ করেছেন শত শত মানুষ।
মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কারণে কারণে নির্গত গ্রিন হাউস গ্যাসে বিশ্ব ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে, সে কারণেই বিজ্ঞানীরা জলবায়ু সংক্রান্ত ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ চাইছেন। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্কও করেছেন তারা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, এই সম্মেলন বিশ্বের জন্য ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার মুহূর্ত।’ দু’সপ্তাহের এই সম্মেলনের প্রাক্কালে নেতাদেরকে তা সফল করার তাগিদ দিয়ে জনসন বলেছেন, ‘আমরা এ মুহূর্তকে কাজে লাগাতে পারব নাকি ফসকে যেতে দেব প্রত্যেকেই সে প্রশ্ন করছে।’ কপ ২৬ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট অলোক শর্মা বলেছেন, পাঁচ বছর আগে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে আমরা যা অর্জন করেছিলাম এবার তেমন চুক্তিতে পৌঁছা কঠিন হবে। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের দেশগুলো তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করার লক্ষ্যমাত্রা নিতে একমত হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এখন ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পথে আছে, যা জলবায়ু বিপর্যয় ঘটাতে পারে, বলছে জাতিসংঘ। বিবিসি ওয়ান এর এন্ড্রু মার শো তে অলোক শর্মা বলেন, ‘তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখাটা এখন নেতাদের ওপর নির্ভর করছে। তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন এবং তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার ওই লক্ষ্য আমরা কীভাবে পূরণ করবে সে ব্যাপারে আমাদের একযোগে একমত হওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরনকারী চীনের মতো দেশগুলোর কাছ থেকে আমরা আরও বেশিকিছু আশা করি এবং এই জলবায়ু সম্মেলন এক্ষেত্রে তাদের জন্য নেতৃত্ব দেখানোর সত্যিকারের একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে।’
সম্মেলনের প্রথম দিনই বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) প্রকাশিত জলবায়ু পরিস্থিতি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখা যাবে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি। জলবায়ু বিজ্ঞানীদের তৈরি ডব্লিউএমও’র এ সাময়িক প্রতিবেদনে চলতি বছরের বৈশ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে আগের বছরগুলোর তাপমাত্রার তুলনা করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপদাহ, বন্যা ও দাবানলের মতো চরম আবহাওয়াজনিত দুর্যোগগুলোর তীব্রতা বাড়ছে। গত দশক ছিল এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ দশক; পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়া যে প্রয়োজন, সে বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকাররা একমতও হয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত এ আয়োজন যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত হওয়া অন্যতম বড় সম্মেলন। সম্মেলনটি গত বছর হওয়ার কথা থাকলেও মহামারীর কারণে এক বছর পিছিয়ে যায়। সম্মেলনে অংশ নিতে অনেক নেতাই গ্লাসগো গেছেন রোমে জি-২০ সম্মেলন শেষ করে। গতকাল মূলত সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী হয়। তাই খুব বেশি আলোচনা এদিন হয়নি। এদিন যারা বক্তৃতা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় তা মালদ্বীপের নিচু দ্বীপগুলোর জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
গ্লাসগোর এই সম্মেলনে বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন, তারা ২০৩০ সালের মধ্যে কতখানি কার্বন নিঃসরণ কমানো যায় তার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন। এ দেশগুলোর প্রতিনিধিরাই ২০১৫ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রির বেশি যেন উপরে না উঠে, তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। কিন্তু চরমভাবাপন্ন আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ তীব্রতর হতে থাকায় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি এড়াতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার তাগিদ দিয়েছেন। রোমে অনুষ্ঠিত জি-২০র খসড়া ঘোষণায় জোটনেতারা তাপমাত্রা যেন প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রির বেশি উপরে না উঠে, তা নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্ত ২০০৯ সালে বিশ্বনেতারা ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য করা জলবায়ু তহবিলে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পূরণ হয়নি। প্রতিশ্রুতিটি পূরণ হতে ২০২৩ সাল লেগে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে বিশ্বনেতাদের চাপে ফেলতে গ্লাসগোতে বিক্ষোভ–সমাবেশ করেছেন শত শত মানুষ। কপ ২৬ সম্মেলনকে সামনে রেখে স্থানীয় সময় শনিবার বিক্ষোভ করেন তারা। বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে গ্লাসগোর প্রাণকেন্দ্রে মিছিল করে। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘শুধু মুখের কথা নয়, পদক্ষেপ চাই’ এবং ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করুন’। এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন নামক সংগঠনের সদস্যরা বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সম্মেলনকে সামনে রেখে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্দোলনে সাড়া জাগানো সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও গতকাল সমাবেশে যোগ দেন। সূত্র : বিবিসি, এএফপি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন