২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেন। সারা বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। তার নেতৃত্বে ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দিয়ে বই উৎসব শুরু হয়। সেই থেকে ১ জানুয়ারি সারাদেশে বই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি বছর নির্ধারিত সময়ে বই পেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় শিক্ষার্থীরা মুখিয়ে থাকবে নতুন বইয়ের জন্য। কিন্তুসেই উৎসবে ভাটার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বই উৎসবের আর দুই মাসও বাকি নেই। কিন্তু এখনো মাধ্যমিক স্তরের ৪৮ শতাংশ বই ছাপানোর জন্য চুক্তিই করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যে সময় আছে এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাদের অভিযোগ, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে গিয়ে বই উৎসবকে হুমকির মুখে ফেলেছে এনসিটিবি। তবে এনসিটিবি বলছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবে পাঠ্যপুস্তক।
জানা যায়, ২০২২ সালে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি এবং মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ কোটি বই ছাপাতে হবে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের ১০ কোটি বইয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ পাঠ্যপুস্তকের কাজ শেষ হয়েছে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৫ কোটির মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ ছাপানোর কাজ শুরু হয়ে১ জানুয়ারি বই উৎসব করতে হলে হাতে নেই দুই মাসও। অথচ মাধ্যমিক স্তরের অর্ধেক বই ছাপাতে এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তিই হয়নি। প্রক্রিয়া অনুযায়ী, চুক্তির পর হবে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড। এরপর ছাপানোর জন্য ৭০ দিন সময় পাবেন ছাপাখানার মালিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করায় মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার কাজ শুরু হয়নি। অপরদিকে প্রাথমিকের প্রায় অর্ধেক বই ছাপার কাজ একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে প্রেসের বই ছাপার সক্ষমতা বাড়িয়ে গত বছরের চেয়ে পাঁচগুণ বই ছাপার কাজ দেওয়ায় হাইকোর্টে রিট করেন মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর নির্ধারিত সময়ের দুই মাস পরও শতভাগ বই দিতে পারেনি। এবার অর্ধেক কাজ প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়ায় বই উৎসবের আগে প্রাথমিকের শতভাগ বই সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, এখন সময় আছে দুই মাস। আরও ১৫ দিন পরে ওয়ার্ক ওর্ডার পাবে, কাজ শুরুর। কীভাবে বছরের প্রথম দিন বই দেওয়া সম্ভব। কোনোভাবেই সম্ভব না। ১ জানুয়ারির মধ্যে সব বই ছাপানো কোনভাবেই সম্ভব না। প্রাথমিকের বই প্রয়োজন ১০ কোটি ১২ লাখ। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের ২ কোটির মতো বই গেছে। সর্বশেষ ওয়ার্ক অর্ডার হলো ১৫ অক্টোবর, যার মেয়াদ ৬০ দিন। এর মধ্যে তো ব্যত্যয়ও ঘটতে পারে। নির্ধারিত সময়ে কিভাবে এতোগুলো বই যাবে, কোনভাবেই সম্ভব না।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানোর জন্য পাঁচ ভাগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ইবতেদায়ি স্তরের (তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি), দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণির এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৮০ লটের মধ্যে ৩২টি লটের বই ছাপার জন্য গত ১৪ সেপ্টেম্বর নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেওয়া হয়েছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী ৯৮ দিনের মধ্যে বই ছাপিয়ে মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করতে হবে। ৩২ লটে মাত্র এক কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৯৭১টি বই রয়েছে। ২০৮লটে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয়, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ২০টি লটে এক কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি বই আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহের চুক্তি করা হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ইবতেদায়ি স্তরের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি, দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণির এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৪৮ লটের বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। ২৪৮ লটে ১০ কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি ছাপানো হবে। একই স্তরের ১০ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৮টি বই ছাপানের জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ১৮৮টি লটের মাধ্যমে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয়, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ১১ কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৫টি বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র দেওয়া হয় ১৯ জুলাই। সব মিলিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার জন্য এখন পর্যন্ত এনসিটিবি চুক্তি করতে পারেনি।
প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, আমি জানিনা কি উদ্দেশ্যে, সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য টেন্ডারের শর্ত পরিবর্তন করে লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করার জন্য এ দেরিটা হলো। সরকারের সবচেয়ে সফল কর্মসূচিটি ঝুঁকিতে ফেরা হলো। তিনি বলেন, আমরা মনে করি কিছুদিন আগে কয়েকজন কর্মকর্তা এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছে, এই কর্মকর্তাদের অতি উৎসাহ, লোভ এবং তারা লাভবান হওয়ার জন্য এ কাজটি করে উৎসবটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত যে, কে কে এর জন্য লাভবান হলো। এখনো বোর্ডে দু’একজন কর্মকর্তা আছেন যারা এর সাথে জড়িত।
অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি বইয়ের মধ্যে একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকেই ৩ কোটি বইয়ের ছাপার কাজ দিতে গিয়ে যত বিপত্তি। দরপত্রের মাঝখানে হঠাৎ সংশোধনী আনে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। আর এতেই এক দশকের বেশি সময় ধরে নতুন বই পৌঁছে দেওয়ার সফলতা ভেস্তে যাওয়ার পথে।
শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, আমাদের দেশে শত শত প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই বইগুলো ছাপাতে সক্ষম। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে গিয়ে সংশোধনী আনা হয়। ১০ কোটি ১২ লাখ বইয়ের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান যদি ৩ কোটি বই ছাপার কাজ নিয়ে যায়। এই বইটি যদি ওখানে কোন না কোন কারণে বা দুর্ঘটনায় দেরি হয় তাহলে পুরো প্রজেক্টটি জিম্মি হয়ে পড়বে। এই ৩ কোটি বই তো আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যেতো। কিন্তু তা না দিয়ে শর্ত শিথিল করে সিডিউলের শর্ত পরিবর্তন করে একটি প্রতিষ্ঠানকে এতো বড় একটি কাজ দেয়া হলো। কি কারণে, কি প্রয়োজনে, কেন এই কাজটি দেয়া হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। এটি একটি অনিয়ম, আমাদের কাছে মনে হয়, এর পেছনে কোন দুর্নীতি থাকতে পারে।
মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান, এনসিটিবি এ বছর টেন্ডারের মাঝখানে হঠাৎ একটি সংশোধনী এনেছে। কোনো প্রেস মালিক যদি গত বছরের চেয়ে বেশি বই ছাপাতে চায় সেক্ষেত্রে মেশিন আমদানির এলসি যাচাই করে সমক্ষতা বাড়ানো হবে। মুদ্রাকররা এ বিষয়ে আপত্তি তুললে পাত্তা দেননি এনসিটিবির কর্মকর্তারা। অগ্রণী প্রিন্টার্সকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়িয়ে প্রাথমিকের ৪৬ লটের কাজ দেওয়া হয়েছে। আবার যাদের মেশিন অত্যাধুনিক রয়েছে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বাজারজাত অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, মাধ্যমিকের বই যেগুলো দরপত্র হয়েছে সেগুলো ছাপানো ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে না। জানুয়ারি চলে যাবে। সে হিসেবে প্রথম দিন বই উৎসব কিভাবে সম্ভব। তিনি বলেন, এনসিটিবির নির্ধারিত দরের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম বা বেশি দর দিয়ে টেন্ডার জমা দিয়েছেন; কিন্তু অগ্রণী প্রিন্টার্স দশমিক এক শতাংশের কম দরে টেন্ডার জমা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, এনসিটিবির নির্ধারিত দর শত শত প্রতিষ্ঠান জানলো না তারা জানলো কী করে? এনসিটিবি থেকে টেন্ডারের দর আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে দুই ধরনের অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বই ছাপার সক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া। বই ছাপার দর আগাম জানিয়ে দেওয়া।
দরপত্রে বারবার শর্ত পরিবর্তনসহ নানা কারণে এবার ছাপানোর কাজে দেরি হচ্ছে স্বীকার করলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন দাবি করেন, বছরের প্রথম দিনেই বই পাবেন শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন, বছরের প্রথম দিন আমরা তাদের হাতে বই পৌঁছে দেব। সেটার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।
নারায়ণ চন্দ্র বলেন, সবসময় যে একই প্রক্রিয়ায় কাজ করা সম্ভব হবে তা নয়, বিগত বছরগুলোতেও আমাদেরকে কোন কোন টেন্ডার রি-টেন্ডার করা হয়েছে। আর এবছর সবগুলো টেন্ডারই রি-টেন্ডার করতে হয়েছে। সে কারণে একটা স্পেস রেখে টেন্ডার করি। কিছুটা সময় লেগেছে। ১ তারিখের মধ্যে বই পৌঁছে দিবো এজন্য কোন দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস প্রদান করলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন