বছরের শুরুর প্রথম দিন ক্লাসের নতুন বইয়ের মজাই আলাদা। এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছেন স্কুল-মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থী। উৎসবের আমেজে বই গ্রহণ করে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ঘরে ফেরেন শিক্ষার্থীরা। এ দৃশ্য প্রতি বছর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক তথা ডলার সঙ্কট, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের গাফিলতি, পছন্দের ব্যক্তিদের কাজ পাইয়ে দেয়ার টেন্ডারবাজি, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং কাগজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বছরের প্রথম দিন ‘নতুন বই পাওয়ার আনন্দ’ থেকে বঞ্ছিত হবেন। মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব শিক্ষার্থীর নতুন বই পেতে আগামী বছরর মার্চ মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি নতুন বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, শত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা আগামী ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেবো।
জানা যায়, এক দশকের বেশি সময় ধরেই ১ জানুয়ারি সারাদেশের সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিচ্ছে সরকার। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে ২০১০ সালে এই ‘নতুন বই বিপ্লবের’ সূচনা হয়েছিল। করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২১ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে বই পেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অবহেলা ও পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ছাপানোর কাজ দিতে গিয়ে চলতি বছর ভাটা পড়েছিল সেই উৎসবে। নির্ধারিত দিনে উৎসব আয়োজন করা হলেও সকল শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময়ের পরে টেন্ডার, ডলার সঙ্কট, বিদ্যুতের লোডশেডিং, কাগজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার আরো বেশি অনিশ্চয়তায় পড়েছে নতুন বছরের বই উৎসব।
বই ছাপানোর দায়িত্ব যাদের সেই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ১ জানুয়ারির মধ্যে অর্ধেক বইও সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। কোনো ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৫৫ এবং বাকি ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বই নির্ধারিত সময়ে এনসিটিবি’র হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হবে। আর সম্পূর্ণ বই পেতে পেতে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগবে। খালি হাতে ফিরতে হতে পারে অনেক শিক্ষার্থীকেই। এতে অনেক শিক্ষার্থীর মন ভেঙে যেতে পারে। ব্যাহত হতে পারে বই উৎসব। এই ব্যর্থতার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্টদের দায়ী করেছেন অনেকে।
জানা গেছে, সরকার এবার প্রথম থেকে নবম শ্রেণির জন্য ৩৪ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণ করছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ৮১২টি বই। তার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৪টি এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ২ লাখ ১৩ হাজার পাঠ্যবই রয়েছে। বাকিগুলো পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। অন্যদিকে মাধ্যমিক পর্যায়ে (স্কুল, মাদরাসা ও কারিগরি) ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি বই ছাপানো হবে।
মুদ্রণ শিল্প সমিতি বলছে, কাগজের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কট দেখা দিয়েছে, বেড়েছে কালির দামও। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কট, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এলসি করতে না পারায় কাগজ তৈরির পাল্প (মণ্ড) আমদানি করতে পারছেন না মিল মালিকরা। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যুতের সমস্যা। এমন অবস্থায় ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠ্যবই মুদ্রণের কর্মযজ্ঞ শেষ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মুদ্রণকারীরা।
এনসিটিবি ও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য মতে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বই ছাপানোর ওয়ার্ক অর্ডার দিতে বিলম্ব করেছে। একই সময়ে ডলার সঙ্কট, বিদ্যুৎ সমস্যা, কাগজের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসে। এছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাণ্ডুলিপি দেয়ার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে বিলম্ব। নভেম্বরের শেষে এসব শ্রেণির পাণ্ডুলিপি হাতে পায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে প্রতি বছরই কালক্ষেপণ করেন। এনসিটিবি বলে আমি বইয়ের মালিক আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলে আমি বই কিনে নেব, এ জন্য যে যার মতামতকে প্রাধান্য দিতে বলে। তাদের এই রশি টানাটানিতে মুদ্রণকারীরা নিষ্পেষিত হয়।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, ২০২২ সালের জন্য যেসব বই ছাপানো এবং সরবরাহ করেছিল মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো সেই টাকা এখনো তারা বুঝে পায়নি। বার বার তাগাদা দিলেও কোনো কাজ হয়নি। ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান আর্থিক সঙ্কটের কারণে বই ছাপানো বন্ধও করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করে ১ জানুয়ারি বই উৎসব করার মতো বই সরবরাহের অনুরোধ জানান।
একাধিক মুদ্রণ ব্যবসায়ী বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহ করার আমরা চেষ্টা করছি, তবে এই সময়ের মধ্যে শতভাগ বই সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সর্বোচ্চ ৬০ ভাগ দেয়া সম্ভব হতে পারে।
চাহিদামতো কাগজ পাওয়া যায়নি জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা যোগাযোগ করেছি। আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। আর মিলগুলো বিদ্যুতের জন্য কাগজ তৈরি করতে পারছে না। আমাদের কাগজের চাহিদা ছিল এক হাজার টন। অথচ পেয়েছি তার অর্ধেক।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, বই ছাপানোর জন্য দরপত্রই দেয়া হয়েছে দেরিতে। এর সঙ্গে কাগজের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সঙ্কটসহ নানামুখী প্রতিবন্ধকতা আছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাপানোর মতো সক্ষমতা আছে। কিন্তু কাগজ সঙ্কটের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না, কাগজই পাওয়া যাচ্ছে না। পাল্প না এলে উৎপাদন হবে কিভাবে? তবে বসুন্ধরা, মেঘনা, সোনালী ও টিকে এই ৪টি প্রতিষ্ঠান যদি শুধু আমাদের বইয়ের জন্য কাগজ উৎপাদন করত তাহলে এই সঙ্কট কেটে যেত।
১ জানুয়ারির পূর্বে কি পরিমাণ বই সরবরাহ সম্ভব হবে জানতে চাইলে তোফায়েল খান বলেন, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে। প্রাথমিকের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ভালো পরিমাণ যাবে, তবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বই যাবে।
তিনি আরো বলেন, প্রাথমিকের বইয়ের জন্য ৫ প্রতিষ্ঠানকে সিংহভাগ কাজ দেয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি চাপ দিতে পারে এবং মনিটর করে তাহলে হয়তো প্রাথমিকের বইয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০-৩৫ ভাগ বই ছাপা হবে। তবে ৩৫ ভাগ বই মানে এমন নয় যে বাকি ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী বই পাবে না। সব মিলিয়ে ৩৫ ভাগ হবে। কোনো শ্রেণিতে সব বই যেতে পারে, আবার কোনো শ্রেণিতে বই নাও যেতে পারে।’
নিম্নমানের কাগজ : পাঠ্যবই মুদ্রণে নতুন সঙ্কটের নাম ‘কাগজ সিন্ডিকেট’। সঙ্কট মাথায় রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাগজের মানে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। সে অনুযায়ী ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা না থাকলেও বই সরবরাহের অনুমতি দেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে কাগজের পুরত্ব (জিএসএম) ঠিক রাখতে হবে। এই সিদ্ধান্তের কারণে দেশে যে পরিমাণ ‘ভার্জিন’ (অব্যবহৃত) পাল্প আছে, তার সঙ্গে ‘রিসাইকলড’ (ব্যবহৃত) পাল্প মিলিয়ে পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ শেষ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু কয়েকটি মিল, কাগজ ব্যবসায়ী, রিসাইকলড পাল্প তৈরির জন্য ব্যবহৃত (পুরনো) কাগজ সরবরাহকারী এবং আর্ট পেপার ব্যবসায়ী-এ চার পর্যায়ে অসাধুরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন মুদ্রাকররা। অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেকে চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না। পাশাপাশি বাড়িয়ে দিয়েছে দাম। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠ্যবই উৎপাদন।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, মুদ্রণ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে দেশে ভার্জিন পাল্পের কাগজ নেই বললেই চলে। মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এ ধরনের কিছু কাগজ আছে। সঙ্কটের সময়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে চানÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পেপার কিনে গুদামজাত করা বা রিসাইকল পাল্প তৈরির পুরনো কাগজের দাম বাড়ানোয় সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে। তিনি মনে করেন, ‘রিসাইকলড’ পাল্পে উজ্জ্বলতায় ছাড় দিয়ে যথাযথ মানের কাগজে বই ছাপানো অনুমোদন করা হলে ১ জানুয়ারির আগে বইয়ের কাজ শেষ করা সম্ভব হতো।
এদিকে কাগজের মানে কিছুটা ছাড়ের সুযোগ নিয়ে নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে ৯টিরও বেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগও পেয়েছে এনসিটিবি। তারা নিম্নমানের বই ছাপিয়ে এনসিটিবিকে হস্তান্তরও করতে যাচ্ছিল। পরে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রায়-প্রস্তুত ৫০ হাজার পাঠ্যবই ও ছাপানো ফর্মা কেটে বিনষ্ট করা হয়েছে। এনসিটিবি জানায়, গ্লোবাল প্রিন্টিং অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট, আমিন আর্ট প্রেস অ্যান্ড প্রিন্টিং, আলামিন প্রেস, সরকার প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস, লিখন আর্ট প্রেস, হাওলাদার প্রেস, এস এস প্রিন্টার্স, নয়ন মনি এবং রিফাত প্রেসে ছাপানো ৫০ হাজার পাঠ্যবই ও বইয়ের ফর্মা কেটে বিনষ্ট করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে এসব বই কেটে ফেলা হয়।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্লোবাল প্রিন্টিং অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট প্রেস’সহ বেশ কিছু প্রেসে প্রস্তুত করা পাঠ্যবই ও বইয়ের ফর্মা কেটে বিনষ্ট করা হয়েছে। প্রথম থেকে এসব প্রেস মালিকদের বলে আসছিলাম নিম্নমানের বই না ছাপার জন্য। কিন্তু তারা শোনেনি। আমরা অনেক বই বাতিল করেছি। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখব। নিম্নমানের বই দেবে, এটা কোনোভাবেই হতে দেয়া যাবে না।
তিনি বলেন, কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বই ছাপিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেবে, আমরা তা মেনে নেব তা হতে পারে না। আমাদের পরিদর্শন টিম মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নজর রাখছে। নিম্নমানের বই ছাপার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উৎসবের উদ্বোধন করবেন। আমাদের চেষ্টা থাকবে প্রত্যেক শিক্ষার্থী যাতে বই হাতে পায়। বই পাবে না এমন কোনো শিক্ষার্থী থাকবে না। ইতোমধ্যে অনেক বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তবে শতভাগ বই দেয়া সম্ভব হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তত ৫০ ভাগ বই দেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন