শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

স্বাবলম্বী হওয়াই দারিদ্র্য দূরীকরণের সহজ উপায়

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

এখন সবাই অনুধাবন করছেন যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। শুধু বিদেশ থেকে আমদানী করে খাদ্যদ্রব্য তথা অন্যান্য পণ্যের চাহিদা মেটানো বা মূল্যহ্রাস কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সাথে কৃষি শিল্পসহ অন্যান্য খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। জনগণের চাহিদা পূরণে উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প পথ নেই।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্বাবলম্বনের ভিত্তি কৃষি। এদেশের তিন চতুর্থাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর। কৃষিকে উপেক্ষা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অসম্ভব। কৃষি উন্নয়নে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রসরতার তাগিদে আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন, সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের সুযোগ নিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে যথার্থ আত্মনিবেদন। ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যায় স্বনির্ভরতা জরুরী। এমতাবস্থায় কৃষিক্ষেত্রে চাপ বাড়ছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা কৃষির মান উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষিজাত উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রযুক্তিবিদ্যায় সাফল্য ও সুফলকে কাজে লাগিয়ে দেশের অনেক শিক্ষিত বেকার আজ স্বাবলম্বী, প্রতিষ্ঠিত। বেকারত্ব দূর করতে চাকরির মোহ ত্যাগ করে তারা নানাভাবে কৃষি, মৎস্য উৎপাদনে নিজেদের নিয়োজিত। আজকাল অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী সরকারী চাকুরির পিছনে ছুটে ক্লান্ত। তারা অনেকেই ভুলে যায়, সীমিত সরকারি ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত চাকরি প্রদান অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে চলছে। তথাকথিত শিক্ষিতদের বাদ দিলেও গ্রামীণ মানুষের যথার্থ যোগদান প্রতিকূল অবস্থাতেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ শিক্ষিত যুবকেরা অনেকাংশে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রতি ঝুঁকছে। তারা স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। কৃষিক্ষেত্রে তাদের আরো অবাধ যোগদান দেশকে অবশ্যই ভবিষ্যতে এক উন্নত দেশের মর্যাদা দিতে পারে, কারণ কৃষিকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

দেশে জনসংখ্যার চাপ বেশি এবং কৃষিক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ছে। শিল্প ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কৃষিতেও দ্রুত উন্নয়ন জরুরি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভ্রান্তনীতি, পাহাড়ী প্রতিকূলতা, রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে, যার প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে কৃষিকে আঁকড়ে থাকাই আমাদের প্রধান ভরসা। কৃষিক্ষেত্রে অবাধ যোগদান, উপযুক্ত পরিবেশ অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার জীবন মানের দিকে তাকানোর ফুরসৎ আমাদের নেই। আমাদের উন্নয়নের পটভূমি কৃষিভিত্তিকই তৈরি করতে হবে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার ২ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবি, অন্যদিকে আমাদের দেশের ৭০ শতাংশই কৃষিজীবী। ফলে পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের এখন মাঠে নামতে হবে এবং সরকারি অনুদানকৃত সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেশের অর্থনৈতিক উদ্ধারকল্পে নিবেদিত হতে হবে। কৃষিক্ষেত্র থেকে মুখ না ফিরিয়ে সেখানো নিয়োজিত থেকে স্বনির্ভর হতে হবে। কৃষির উন্নতিতেই গ্রামীণ স্বনির্ভরতা দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। বিভিন্ন পরিকল্পণায় সরকার কৃষির উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। কোথায়, কত টাকা মঞ্জুর হচ্ছে, কিভাবে খরচ হচ্ছে শিক্ষিত সমাজকে তার খতিয়ান রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মিডিয়া এবং সাংবাদিকদের ভূমিকাও অপরিসীম। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রথমেই লক্ষ লক্ষ অর্ধাহারী, অনাহারীর মৌলিক চাহিদার দিকে তাকানোর আবশ্যকতা রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি নিতান্ত পিছিয়ে নয়। দেশের অর্থনীতি গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থানের উপরই টিকে রয়েছে। প্রয়োজন আরো গতি সঞ্চার। কৃষি এবং কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আধুনিকতা চিরাচরিত দেশীয় জীবনযাত্রা বদলে দিতে পারে। হস্তশিল্প, বয়ন শিল্প, খাদি ও গ্রামোদ্যোগের প্রভাব আমাদের এতদঞ্চলের অনেক উন্নতি ঘটাতে পারে। এছাড়াও মৎস্য চাষ, ফল ও ফুল চাষ, পাট চাষ, পান চাষ, পশুপালন, দুগ্ধ প্রকল্প, ইক্ষু চাষ এবং চা শিল্প ও কাগজ শিল্প আমাদের এতদঞ্চলের অর্থনীতিকে নতুন দিশা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আরো অবাধ যোগদান এবং পরিকল্পিত কার্যক্রম শিক্ষিত যুবক-যুবতীকে স্বনির্ভরতা দিতে পারে। শিক্ষা পদ্ধতিকে সে ধরনের কর্মমুখী করার লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার করতে হবে। পাহাড়ে জুম চাষ অর্থনীতিতে যথেষ্ট সমাদৃত। এসব ক্ষেত্রে তাদের উন্নত চিন্তাধারা এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। বনজ সম্পদের অবাধ ধ্বংস রোধ করে জুম চাষীদের উন্নত প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা ও অনুদানের প্রয়োজন এবং সেটি সুনিশ্চিত করতে হবে। আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান বেকার সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে। এজন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিতে হবে বাস্তবমুখী ও উৎপাদনমুখী পদক্ষেপ। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান চিরন্তন। গ্রামীণ মহিলারা পুরুষের কর্মক্ষেত্রের নিত্য সঙ্গী। পশুপালন থেকে আরম্ভ করে চাষাবাদ এবং দ্রব্যের বাজারীকরণ সর্বত্রই নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের কৃষিক্ষেত্রে অনেক শিক্ষিত মহিলা ও যুবতীদের প্রত্যক্ষ অবদান চোখে পড়ার মতো। তারা মাঠে বর্ষাকালীন শস্য থেকে রবিশস্য উৎপাদনের সময় পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রম করে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সিংহভাগই মহিলাকেন্দ্রিক। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে মেয়েদের অবাধ যোগদান আমাদের অর্থনীতিকে শুধু চাঙ্গা করবে না বরং মজবুত আর্থসামাজিক পরিবেশের সূচনা ঘটাবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের আরো সক্রিয় হতে হবে এবং তাদের প্রতি সমাজ ও সরকারের আরো সহায়তা করতে হবে।

আগামী বাংলাদেশ অবশ্যই গড়ে উঠতে পারে কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি। শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এগুতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করে এ অনুযায়ী তাদের স্বাবলম্বী হতে হবে। কৃষি এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন