সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইনটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে নৈরাজ্য বেড়েই চলছে। সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো হলো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকের অদক্ষতা, চালকের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মটর সাইকেল চালানো, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজী, মাদকাসক্ত চালক, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা, অবৈধভাবে ও ওভারটেকিং, চালকের আসনে হেলপার, অতিরিক্ত যাত্রীবহন ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক অভিশাপের নাম। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনার পেছনে গাড়ি চালকদের অমনোযোগিতা ও অদক্ষতা অনেকাংশে দায়ী। যানবাহন চালকদের ইউনিয়নের কাছে সরকার জিম্মি বললেও অত্যুক্তি হবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। এতে দেশের জিডিপির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি স্বজন হারানো বা পঙ্গুত্ব বরণ করার কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে অনেক পরিবার নিরালম্ব হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা কমছে। সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনা দূর করতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। দূরপাল্লার রুটগুলোতে অতিরিক্ত চালক রাখা ও চালকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। সড়কে নৈরাজ্য যেন বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেকটা যানবাহন যেন একেকটা দানবে পরিণত হয়েছে। একটু আগে যাওয়ার জন্য, একজন যাত্রী বেশি পাওয়ার জন্য পরিবহন চালক ও তাদের সহকর্মীরা যা ইচ্ছা তাই করে। ফিটনেসহীন যানবাহনে ফুয়েল ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালত থেকে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সড়কে শৃঙ্খলা না থাকার ও দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো যানজট। এখন অনেক জেলা শহরেও রাজধানী ঢাকার মতো যানজট দেখা যায়। মহাসড়কগুলোর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সত্ত্বেও সেখানে কম বেশি যানজট হচ্ছে। আবার যেখানে যানজট নাই, সেখানে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর ফলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও গাড়ির অনুপাতে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে, প্রাণহানিও হচ্ছে অনেক বেশি। একথা ও সত্য সরকারের একার পক্ষে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব নয়। এটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক থেকে শুরু করে নাগরিকদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তবে সরকারি তরফের দায়িত্ব অনেক বেশি। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে যাত্রী-পরিবহন মালিকরা ও শ্রমিকগণ আরও দায়িত্বশীল হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকার কারণে কেউ আইন অমান্য করার সাহস দেখায় না। আমাদের দেশে পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারে না। অনেক ফুটপাত দখল হয়ে গেছে। কোনো কোনো ফুটপাতে একটু জায়গা থাকলেও সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা নিরাপদ থাকতে পারছে না। পরিবহন চালকরা ফুটপাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছে। জুলাই ২০১৮ রাজধানীতে ফুটপাতের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষর্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে। তখন শিক্ষার্থীরা সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দেশের ইতিহাসে এ ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে, ইচ্ছে থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব।
পরিবহন শ্রমিকদের গাড়ির মধ্যে যাত্রীদের বসিয়ে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতিদিন লাখ লাখ আনফিট গাড়ি চলছে সড়কে। বিনা প্রশিক্ষণে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার ও হেলপাররা। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে আনফিট গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সড়কে অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। কেউ যেন লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে না পারে সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকের কাছে যাত্রী সাধারণ জিম্মি হয়ে না থাকে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর হতে হবে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি-বেসকারি পর্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একটানা ৬-৭ ঘন্টার বেশি গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে ওভারটেকের প্রবণতা যে কোনোমূল্যে বন্ধ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে অনেক রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও দেখা যায় না। শুধু সিসি ক্যামেরা আর সিগন্যাল লাইটের মাধ্যমেই ট্রাফিক কন্ট্রোল করা হচ্ছে। জনগণও জেব্রা ক্রসিং ব্যতীত রাস্তা পার হয় না। আর আমরা জেব্রা ক্রসিং সামনে পেলেও তা দিয়ে যাই না। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। গণপরিবহনে শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে, শৃঙ্খলা আনতে হবে। প্রায়ই বাসের হেলপার বা শ্রমিকদের কাছে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হয়। চলন্ত বাসে ধর্ষণের খবরও মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে লেখা-লেখি, সভা-সেমিনার অনেক কিছুই হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। নিরাপদ সড়ক ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
দুর্ঘটনায় আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করতে হবে।
দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহন প্রায় ৪৪ লাখ ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। প্রতিটি যানবাহন নিবন্ধন বছর বছর ফিটনেস নবায়ন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুকালে একটি ন্যূনতম নির্দিষ্ট অংকের ফি আরোপ করে এই তহবিলে জমা করা যেতে পারে। তাছাড়া হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানার অর্থ থেকে নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে এই তহবিল গঠন করা যেতে পারে।
গণপরিবহন ব্যবস্থাকে যাত্রীবান্ধব করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
যানবাহনের গতি তারতম্য নিয়ন্ত্রণ ওভারটেকিং, ওভার লোডিং ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা (উন্নত দেশের মতো) গ্রহণ করতে হবে।
গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক জরিমানা প্রয়োগ করার ব্যাপারে পুলিশের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
পথচারীদের আইন মানার জন্য সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের জন্য তহবিল গঠনের বিষয়ে রুল জারি করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। রুলে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৫৩ ও ৫৪ ধারা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অবিলম্বে একটি আর্থিক সহায়তা তহবিল এবং বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই রুল জারি করেছেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
সড়কে শৃঙ্খলা বা নিরাপদ সড়কের বিষয়টির সাথে মানুষের জীবন মৃত্যু জড়িত। সরকারের বুঝতে হবে, এর সঙ্গে জড়িত শুধুমাত্র জননিরাপত্তাই নয়, জড়িত সরকারের ভাবমর্যাদার প্রশ্নও। এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বাংলাদেশে ৫১ হাজার ৬৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ৫০৬ সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ ট্রাফিক আইন মানে এবং আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ ট্রাফিক আইন মানে না। এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইন না মানার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, পথচারী, যাত্রী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্যোগও প্রয়োজন।
লেখক: সভাপতি, যাত্রীকল্যাণ পরিষদ, মৌলভীবাজার ও কলামিস্ট, গবেষক, ব্যাংকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন