গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ‘শালমারা হল্ট’ নামে রেলস্টেশনটি দীর্ঘ এক যুগেও পূর্ণাঙ্গ রেলস্টেশনে রূপান্তর না হওয়ায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পিছিয়ে পরা এ জনপদের মানুষেরা। স্টেশনটিতে ডাবল লাইন নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে শালমারাকে পূর্ণাঙ্গ স্টেশনে উন্নীত করা হলে সর্বক্ষেত্রে তারা এগিয়ে যাবে বলে এলাকাবাসীর দাবি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৭নম্বর ইউনিয়ন হচ্ছে শালমারা। বগুড়া জেলার সোনাতলা ও শিবগঞ্জ এবং গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার সীমানা ঘেষা ইউনিয়ন ‘শালমারা’ উপজেলার পিছিয়ে পরা জনপদগুলির মধ্যে অন্যতম। কয়েক বছর আগেও সেখানে ছিলোনা কোন পাকা সড়ক। প্রতিদিন ছোট-বড় কয়েকটি কাঁচারাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে চার কিলোমিটার দক্ষিণের সোনাতলা অথবা তিন কিলোমিটার উত্তরের মহিমাগঞ্জে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হতো কয়েকশ’ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ এখানকার সহস্রাধিক মানুষকে। ওই গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথে প্রতিদিন অনেকগুলো ট্রেন চলাচল করলেও স্টেশন না থাকায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওই দুই স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হতো তাদের। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, এক সময় উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত কাঁচাকলা কিনে এনে পাকানোর পর ট্রেনে ফেরী করে বিক্রি করতো এখানকার কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আশির দশক থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে গাভীর দুধ সংগ্রহ করে তৈরি করতো ‘ছানা’। রসগোল্লা, রসমালাই ইত্যাদি মিষ্টান্ন তৈরির প্রধান উপাদান এ ছানা সরবরাহ করা হতো গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলা শহরসহ বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে। এরপর কলা পাকিয়ে বাজারজাত করার ব্যবসা শুরু হলে ব্যবসায়ী ও ব্যবসার পরিধি বিস্তৃতি লাভকরে। বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁচাকলা বহন করে আনতে রিক্সাভ্যান এবং পাকাকলা বিক্রির জন্যে ৩-৪ কিলোমিটার রাস্তা কাঁধে অথবা মাথায় ঝাপি বহন করতে হতো তাদের। শালমারা এলাকার বিভিন্ন বয়সী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মৌসুম ভেদে কলা, আম, আনারস, বড়ই এবং বিদেশ থেকে আমদানীকৃত আপেল, কমলা, খেজুরসহ বিভিন্ন প্রকার ফল মাথায় বহন করে নিয়ে ট্রেনে ট্রেনে ফেরী করে বিক্রি করা শুরু করেন ধীরে ধীরে। সাধারনতঃ রেলস্টেশনের আশপাশ এলাকার মানুষরাই ট্রেনে এমন ব্যবসা করে থাকলেও ব্যতিক্রম এই শালমারার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। জীবিকার প্রয়োজনে তারা অনেক দূরের মহিমাগঞ্জ এবং সোনাতলা রেলস্টেশনে ফলের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠে ফল বিক্রি করতো। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৯ সালের বন্যা যেন আর্শিবাদ হয়ে আসে শালমারায়। একটি ছোট রেলসেতু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হলে মেরামতকালীন প্রতিদিন প্রতিটি ট্রেন নিয়ম মেনে এখানে থামতে বাধ্য হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এখানকার ফেরীওয়ালা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ওই সময়। প্রতিদিন এখান থেকে শত শত কলার ঝাঁকা ট্রেনে ওঠানো হতো ভাঙ্গা রেলসেতুতে ট্রেন থামার সুযোগে।
ওই সময় দীর্ঘ দিনের কষ্টকর অবস্থার পরিবর্তন হওয়া এ সাময়িক ট্রেন বিরতির সুযোগকে স্থায়ী করার জন্য আবেদন এবং আন্দোলন শুরু করেন এখানকার সর্বস্তরের মানুষ। এ প্রেক্ষিতে ২০০১ সালে ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে রেলস্টেশনটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এই স্টেশনকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, এনজিও, বীমাসহ বিভিন্ন অফিস। পাল্টে গেছে এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। ফেরীওয়ালাদের অনেকেই এখন হয়েছেন মহাজন। মহাজন, বেপারী, খুচরা বিক্রেতা, ফেরীওয়ালা, কুলিসহ বিভিন্ন পেশায় দুই শতাধিক মানুষ প্রতিদিন তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে সততার সাথে আয় করছেন হাজার হাজার টাকা। এর ফলে এক সময়ে প্রায় সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা শালমারা এখন শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। শালমারা রেলস্টেশন এলাকার কলার মহাজন জানালেন, প্রতিদিন সকালের এ দুটি ট্রেনে করে এখান থেকে গড়ে পাঁচ-ছয় লক্ষ টাকার পাকা কলা পাঠানো হয় বিভিন্ন এলাকায়। ট্রেনে ফেরী করে কলা ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ফলমুল বিক্রি করে এখন স্বচ্ছলতা এনেছে এখানকার দরিদ্র পরিবারগুলো। একটি বেসরকারী ট্রেন পরিচালনা কোম্পানীর কমিশন এজেন্ট অভিযোগ করে বলেন, রেলের নিজস্ব কোন কর্মী না থাকায় প্রতিদিন যাত্রীরা টিকেট করতে না পেরে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। রেলও হারাচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব। স্টেশনটিতে ডাবল লাইন নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে শালমারাকে পূর্ণাঙ্গ স্টেশনে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন শালমারা রেলবাজারের ব্যবসায়ীরা। উন্নয়ণ, সমস্যা আর সম্ভাবনার উজ্জ্বল উদাহরণ শালমারার লোকজন স্টেশন স্থাপনের জন্য সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলো সমাধানের দাবি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন