দুর্নীতির পরিধি ঃ আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায়, সারা পৃথিবীকেই দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু নীতি বহির্ভূত সকল প্রকার কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তা সবই এর আওতাভূক্ত। যেহেতু আয়-উপার্জন জীবনের বিশাল অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে যৌক্তিক কারণেই বড় করে দেখা হয়। দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তৃত একটি পরিভাষা। নীতি হিসেবে আমরা যদি ইসলামকে বেছে নেই তবে দুর্নীতিরও একটি সংজ্ঞা প্রয়োজন। ইসলামে সংজ্ঞা যদি এই হয়, ‘আল্লাহর বিধান ও দীনের সামনে আত্মসমর্পণ’ অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা, দ্বারা আল্লাহ সকল বিধানের পরিপূর্ণতা ঘটিয়েছেন সেগুলো মনে প্রাণে মেনে নেয়া। যিনি মেনে নিবেন তার মধ্যে কতগুলো গুণ-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হবে; যথা: তিনি নীতিবান হবেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সদা তৎপর থাকবেন, তার মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পাবে ইত্যাদি। বিপরীত দিকে ইসলামী শরীয়তে অপরাধ (জারীমা) বলেও একটি পরিভাষা রয়েছে। দুর্নীতি একটি অপরাধ। যে সম্পর্কে আল্লাহ হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) অথবা তাজীর (দণ্ডবিধি) দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে।’ ‘ড. মোহাম্মদ মোস্তাফা কামাল, মৌলিক সমস্যা সমাধানে ইসলামী আইন, গবেষণা বিভাগ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, জানুয়ারী-২০০৬’
মানুষের ইচ্ছা শক্তির দ্বারা সংঘটিত নৈতিক কর্মসমূহের বিপরীতে দুনিয়া ও পরকালে পুরস্কৃত করা হবে এবং অনৈতিক বা পাপাচারের পরিণামে শাস্তি প্রদান করা হবে। মানুষের ইচ্ছা শক্তি হচ্ছে বিনিময়ের মাপকাঠি। ইচ্ছাশক্তি যখন অপরাধ কাজের অবয়বে প্রকাশিত হয়, তখন সেটাই দুর্নীতি এবং সেটাই দণ্ডযোগ্য। এ অপরাধ মানুষের মধ্যে মন্দ চর্চার দ্বারা বিকশিত হয়। মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা চারটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। তা হলো-প্রভুত্বের গুণাবলী, শয়তানী গুণাবলী, পশুত্বের গুণাবলী ও হিংস্রতার গুণাবলী। ‘প্রাগুক্ত’ প্রভুত্বের গুণাবলী দুশ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটায়। যেমন: অহংকার, গর্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রশংসা ও গৌরবের মোহ, বিরোধিতা ও চিরস্থায়ীত্বের মোহ, সবার উপরে বড়ত্বের অনুসন্ধান ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্র বিধ্বংসী গুণ। এগুলোই দুর্নীতির জন্ম দেয়। শয়তানী গুণাবলী থেকেও অংসখ্য শাখা-প্রশাখা জন্ম পক্ষান্তরে এ দু’জন যদি বিকৃত স্বভাব ও কুরুচিপূর্ণ মনের অধিকারী হন এবং আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার অভিপ্রায় নিয়ে উচ্ছৃংখল আচার-আচরণ, কথা-বার্তা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিসরে চালু করেন, তবে তাদের পরিবারটি নৈতিকতা বিবর্জিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
সেখানে শ্রদ্ধাবোধ, লজ্জা-শরম, স্নেহমমতা ও ভালবাসার পরিবর্তে বেয়াদবি, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও উচ্ছৃংখলতা ব্যাপকহারে চালু হবে। আমাদের সমাজে উচ্ছৃংখল কিছু পিতা-মাতা এমনও রয়েছেন যে, নিজেদের কোমলমতি ও নিষ্পাপ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একই সাথে দেশী-বিদেশী টিভি পর্দায় নর্তক-নর্তকীদের অলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ নাচ, অশ্লীল অঙ্গভক্তি ও বিকৃত যৌনাচারমূলক দৃশ্য তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করেন। একটি শিশু দুশ্চরিত্র হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য যতগুলো উপকরণ প্রয়োজন সবগুলোর যোগান এ পিতা-মাতাই দিয়ে থাকে। আবাদুল্লাহ ইবনে আমির রা. বলেন, রসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। বর্ণনাকারী বলেন, নবী স. অশ্লীলভাষীও ছিলেন না এবং অশ্লীলতার ভানও করতেন না।’ ‘ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-বিরর ওয়াস সিলাহ, অনুচ্ছেদ: মা জাআ ফিল কুহশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫০’ নবী স. বলেন, ‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অত:পর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বা খৃস্টান বানায় অথবা অগ্নি-উপাসক বানায়।’ ‘ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-কাদার, অনুচ্ছেদ: মা জাআ কুল্লু মাওলুদিন আলাল-ফিতরাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬৬।’
পিতামাতাই যদি নিজ হাতে নিজের সন্তানদেরকে ধ্বংসের পথে তুলে দেন তবে সে সমস্ত পিতা-মাতাকে মূলত: দেশ ও জাতির শত্রু বলেই আখ্যায়িত করা যায়। কারণ অপরিণামদর্শী এসব পিতা-মাতাই জাতীয় দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, গডফাদার, আন্তর্জাতিক চোরাচালানী, চোর-ডাকাত বানাবার সবগুলো উপাদান চেতন বা অবচেতনে পারিবারিক পরিবেশে ছোট কচি মনের শিশুটির জন্য প্রধান যোগানদাতার ভূমিকা পালন করেন। তাই সকল পিতামাতার উচিত নিজের প্রাণপ্রিয় শিশুটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসাবে গড়ে তোলার নিমিত্তে পারিবারিক পরিবেশে আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলুল্লাহ স. প্রদর্শিত পন্থায় সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা চালু করা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঃ পরিবারের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার দ্বিতীয় প্রধান পাঠশালা। এ পাঠশালার পাঠ্য তালিকাও একটি শিশুর জীবনের ভিত রচনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে জাতিসত্তা ও সভ্যতার অবকাঠামো। জাতীয় চরিত্র গঠন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী সৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অবাধ ভোগবাদী সিলেবাস চালু আছে, যা আলোকিত লোক তৈরীতে সম্পূর্ণ অক্ষম। বর্তমানে লক্ষ্য করা যায়, দুর্নীতিবাজদের একটা বিরাট অংশ বর্তমান প্রচলিত শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত। যারা কলমের খোঁচায় ও ফাইল আটকিয়ে রেখে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, অথচ এ শিক্ষাকেই বলা হয় ‘শিক্ষাই আলো’। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্ত উচ্চশিক্ষিত লোক কেন আজ অন্ধকার জগতের বাসিন্দা? প্রকৃতপক্ষে উচ্চশিক্ষিত হওয়া আর সৎ লোক হওয়া এক কথা নয়। সৎ ও আধুনিক যোগ্য লোক গঠনের জন্য অবশ্যই আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন