সারাদেশে মাদক চক্রের শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে উঠার কারণে দিন দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের পাঁচটি সংস্থা মাদক ব্যবসায়ীদের যে তালিকা জমা দিয়েছে তা পর্যালোচনা করে ১৪ হাজার মাদক ব্যবসায়ীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সারাদেশে মাদকের গডফাদার রয়েছে ৯০০ শতাধিক। শুধু রাজধানীতে আছে ৩৭ জন। মাদকের বেশিরভাগ গডফাদার দুবাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। চিহ্নিত গডফাদাররা গা-ঢাকা দিলেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ‘হোম ডেলিভারি’ হচ্ছে বিভিন্ন মাদক। মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে সুন্দরী টিনএজ মেয়েদের। বিশেষ করে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে বানের পানির মতো মরণ নেশা ইয়াবা এদেশে ঢুকছে। বর্তমানে দেশে মাদক সেবনকারীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লক্ষ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫%। মাদক সেবনকারীরা প্রতিদিন এই মাদকের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে তার বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা, যা বছরে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে প্রতি বছর পদ্মাসেতুর মতো ২টি সেতু বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
ক্ষমতাধর চোরাকারবারীরা দেশের বিভিন্ন সীমানা দিয়ে বিশেষ করে ভারত ও মায়ানমার থেকে চোরাই পথে মদ, গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, আফিম, আইস, এলএসডি, ডিএমটি, কোকেন, এনপিএস, ম্যাজিক মাশরুমসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর মাদক আমদানি করে দেশের অভ্যন্তরে হাজার হাজার মাদকদ্রব্য বিক্রীর আখড়া গড়ে তুলেছে। মাদকদ্রব্য সহজপ্রাপ্য হওয়ায় যেখানে সেখানে বিশেষ করে বস্তি, পানের দোকান, চায়ের দোকান, মুদি-দোকান, ঔষধের দোকান, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, ওভার-ব্রিজ, আন্ডার-গ্রাউন্ড বাইপাসে অহরহ বিক্রি হচ্ছে। বাহন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিছু কুরিয়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, মানুষের পেট, সবজির গাড়ি, প্রাইভেট গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। মাদক সেবনকারীদের অধিকাংশই তরুণ, গার্মেন্ট শ্রমিক, গাড়িচালক ও হেলপার এবং স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী। ইদানিং চোরাচালানের সাথে জড়িত দরিদ্র শিশু ও মহিলারাও মাদকদ্রব্য সেবন করছে। মাদক সেবনে ড্রাইভারের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনহানী ঘটছে। ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ, জাতির ভবিষ্যৎ। নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুনের মতো কর্মকান্ড। চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে ভুগছে অভিভাবক মহল। নেশাগ্রস্থ সন্তানের এলোমেলো চলাফেরা, অসংলগ্ন কথাবার্তা পিতামাতা অভিভাবক মহল যখন বুঝতে পারে তখন আর কিছুই করার থাকে না।
মরণ নেশা শহর হতে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভের কারণে সহজে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এই চরম সত্যটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপলব্ধি করে মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। অনেকটা কমে এলেও বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, আবার যেন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মাদক ব্যবসায় লাভের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি হওয়ায়, মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এই ব্যবসা ছাড়তে পারছে না। মাঝে মাঝেই শোনা যায় লক্ষ লক্ষ পিছ ইয়াবা ও ভয়ংকর আইস, এলএসডি, ডিএমটি, কোকেন, এনপিএস, ম্যাজিক মাশরুম ধরা পড়ছে। মাদক নির্মূলে ছোট খাট কিছু ব্যবসায়ী নির্মূল করা গেলেও গডফাদারদের তেমন কাউকে ধরা সম্ভব হয়নি। মাদকে জড়িত গডফাদারদের নির্মূল করা না গেলে দেশ থেকে মাদক বিস্তার রোধ করা আদৌও সম্ভব নয়। বেশ কিছু দিন ধরে ধড়পাকড়ের জোরালো ভূমিকা না থাকায়, পলাতক মাদক ব্যবসায়ীরা আবার নিজ স্থানে তৎপরতা শুরু করেছে। তাছাড়া যারা প্রতিহত করবে তাদেরই কিছু অসাধু ব্যক্তি মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে। মাদক নির্মূল অভিযান দেশের ৯৫% মানুষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সফল না কেন, এটা ভেবে দেখার দরকার। সন্ত্রাস দমনের মতো সরকারকে এ ব্যাপারেও কঠিন ভূমিকা নিতে হবে। মাদক ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা যে দলেরই হোক না কেন, সরকারকে অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের দমন করতে হবে। যোগানদাতা ও গডফাদারদের দেশ, জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে স্বল্প সময়ে বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেবনকারীদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। মাদক সেবনকারীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি নিরাময় কেন্দ্র আছে মাত্র ৫টি, প্রয়োজনের তুলনায় এটা একেবারেই অপ্রতুল। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনবল একেবারেই কম। এর জনবল বৃদ্ধির সাথে সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের তৎপরতা, আন্তরিকতা বাড়াতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন