অক্টোবরের শেষের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পোপ ফ্রান্সিসের সাথে সাক্ষাত করেন এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম খ্রিস্টান জনসংখ্যার দেশ ভারতে আমন্ত্রণ জানান। এর প্রায় দুই সপ্তাহ আগে, মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)-এর আদর্শ সংক্রান্ত পরামর্শদাতা এবং বিজেপির চরমপন্থী অঙ্গসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর প্রধান মোহন ভগবত হিন্দুদেরকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ধর্মান্তর এবং জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের বিষয়ে সতর্ক করেন, যেখানে বিশাল খ্রিস্টান জনসংখ্যা রয়েছে।
বিজেপিসহ হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর অঙ্গসংগঠন সংঘ পরিবারের প্রধান হিসাবে ভাগবতের বক্তৃতা সাম্প্রতিক সময়ের জন্য ভারতজুড়ে একটি নতুন কর্মসূচি হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। তার বক্তৃতার ৩ দিন পর মধ্যপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক রামেশ্বর শর্মা একটি জনসভার বক্তৃতায় ‘চাদরমুক্ত, ফাদারমুক্ত ভারত’ (বোরখা পরা মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকমুক্ত ভারত)-এর আহ্বান জানান। আরএসএসের লক্ষ্য ভারতকে একটি জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্রতে পরিণত করা।
তাদের বক্তৃতাগুলো ভারতের বিভিন্ন অংশে খ্রিস্টান এবং গির্জাগুলোতে সহিংস আক্রমণকে উস্কে দিয়েছে। চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা তাদের শিরñেদ করার জন্য এবং হিন্দুদের কথিত ধর্মান্তর বন্ধ করার জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান করেছে। নয়াদিল্লিতে তারা একটি গুদামকে একটি গির্জায় পরিণত করার অভিযোগে ভাঙচুর করেছে এবং গির্জাটিতে রবিবারের প্রার্থনার সময় ‘বিশ্বাসঘাতকদের গুলি কর’ বলে তাদের চিৎকার করতে দেখা গেছে একটি ভিডিওতে।
অক্টোবরে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর একটি প্রতিবেদন অনুসারে ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে খ্রিস্টানদের ওপর ৩শ’টিরও বেশি সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অন্তত ৩২টি ঘটেছে কর্ণাটকে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, খ্রিস্টান-বিরোধী সহিংসতার মোট ৩শ’ ৫টি ঘটনার মধ্যে ১শ’ ৬৯টি অভিযোগ নিবন্ধিত হয়েছে উত্তর ভারতের ৪টি রাজ্যে, ৬৬টি বিজেপিশাসিত উত্তর প্রদেশে, ৪৭টি কংগ্রেস শাসিত ছত্তিশগড়ে, ৩০টি উপজাতি অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডে এবং ৩০টি বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে। ভারতের অন্তত ৯টি রাজ্য ধর্মান্তর বিরোধী আইনের পরিকল্পনা করছে। এগুলোর মধ্যে ছত্তিশগড় ভারতের খ্রিস্টানবিরোধী বিদ্বেষের একটি নতুন সূতিকাগার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
৩ অক্টোবর প্রায় ২৫০ হিন্দুত্ববাদীদের একটি দল উত্তরাখণ্ড রাজ্যের বিজেপি শাসিত রুরকিতে লোহার রড নিয়ে একটি গির্জা ভাংচুর করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আল জাজিরাকে জানায় যে, হামলার সময় চার্চে প্রায় এক ডজন লোক ছিল। গির্জার যাজকের মেয়ে পার্ল ল্যান্সকে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গির্জার কর্মী রজত কুমারের মাথায় একাধিকবার লোহার রড দিয়ে আঘাত করাতে সে গুরুতর জখম হয়। যাজকের বড় মেয়ে ইভা ল্যান্স জানান যে, ‘হামলার আগে পরিবার অন্তত চারবার পুলিশকে সন্দেহজনক কার্যকলাপের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
১ অক্টোবর ছত্তিশগড়ের সুরগুজা জেলায় ‘ধর্মান্তর বন্ধ করুন’ সমাবেশের জন্য ১ হাজারেও বেশি লোক জড়ো হয়, যা দেশটির ধর্মান্তর বিরোধী বিক্ষোভের অধীনে সংগঠিত একটি ধারাবাহিক কার্যক্রম। সমাবেশটির বক্তৃতায় কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা পরমাত্মানন্দ মহারাজ মানুষকে ‘ধর্মান্তরে লিপ্ত খ্রিস্টানদের’ সবক শেখানোর জন্য কুড়াল হাতে নিজেদের সজ্জিত করার আহ্বান জানান। বিজেপি সাংসদ রামবিচার নেতাম, প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ নন্দ কুমার সাই এবং ছত্তিশগড় রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র অনুরাগ সিং দেও তার সভাতে উপস্থিতিতে তিনি বলেন, ‘আপনারা কুড়াল কেন রেখেছেন? তাদের শিরচ্ছেদ করুন।’ তিনি জনতাকে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ‘থামাও, সতর্ক কর এবং হত্যা কর’ নীতি অনুসরণ করতে বলেন।
উল্লেখিত ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। এর আগে, সেপ্টেম্বরে ভিলাই জেলায় পুলিশ কনস্টেবলদের উপস্থিতিতে হিন্দু ডানপন্থী সংগঠনের নেতা জ্যোতি শর্মা একজন যাজককে মারধর করলে তার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। তিনি এর জবাবে আল-জাজিরাকে সগর্বে বলেন যে, এটি তাকে আক্রমণ ও নির্যাতন করা থেকে বিরত করবে না। ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফ্রন্টের সভাপতি উইলিয়াম মাইকেলসের মতে, বিজেপি শাসিত রাজ্য কর্ণাটকেও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে খ্রিস্টানদের উপর হামলা বেড়েছে।
মোদির সরকার সম্প্রতি দেশের গির্জাগুলির একটি জরিপ করার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেগুলোতে কথিত ‘জোরপূর্বক ধর্মান্তর’ তদন্ত করার জন্য এবং তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মোতায়েন করেছে। বেলাগাভির বেশ কয়েকজন যাজক এবং খ্রিস্টান জানিয়েছেন যে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন শুরু না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থনা করতে গির্জায় যাওয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ তাদের সতর্কবার্তা দিয়েছে। এবারের বিধানসভার অধিবেশনে বিজেপির পক্ষ থেকে একটি ধর্মান্তর বিরোধী বিল প্রস্তাব করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ নিবন্ধনকারী একজন খ্রিস্টান অধিকার কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক অতীতে, কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ তীব্র করেছে। আমরা ছত্তিশগড়ের বৃহৎ সমাবেশ, রুরকিতে গির্জায় হামলা, সুকমায় পুলিশ আদেশ, কর্ণাটকের গীর্জাগুলোর জরিপ এবং ধর্মান্তর নিয়ে মোহন ভাগবতের আলোচনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে পারি না। সোজা কথায়, মুসলমানদের পরেই খ্রিস্টানদের পালা। এমন নয় যে এই আক্রমণগুলো নতুন, কিন্তু তারা চায় যে, সেগুলো জনসাধারণের চোখে আরও দৃশ্যমান হোক।’
অপূর্বানন্দ, যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি সাহিত্য পড়ান এবং ভারতে ধর্মীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে নিয়মিত লেখেন, বলেছেন, ‘খ্রিস্টান-বিরোধী সহিংসতার স্বাভাবিককরণ গভীরভাবে উদ্বেগজনক। একটি কথিত ভিন্ন অপরাধের জন্য একটি ভিন্ন লক্ষ্য (মুসলিম ছাড়া) বেছে নেওয়ার মাধ্যমে, ভারতে ‘হিন্দুত্ব’ (হিন্দু আধিপত্যবাদী) প্রকল্প তার সংখ্যালঘু বিরোধী বিদ্বেষে বৈচিত্র্য এবং বস্তুনিষ্ঠতা যোগ করছে। এতে এর অনুসারীদের কাছে সংখ্যালঘু বিরোধী ঘৃণা এবং স্বপ্রণোদিত ন্যায়-বিচার করাকে যুক্তিযুক্ত এবং আরও স্বাভাবিক দেখায়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন