চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন। প্রতিবন্ধকতা দূর ও সেবার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বন্দরের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থা তৈরি হয়েছে, যার ফলে এই বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানির পরিমাণ বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজস্ব আদায়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে পাথর, গম, চাল, পেঁয়াজ, শুঁটকি, ফল ও টমেটো। এছাড়া এই শুল্ক স্টেশনে পাঁচ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩২ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে; আদায় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ।
শতভাগ ই-পেমেন্ট বাস্তবায়ন, বিকম সফটওয়্যার ব্যবহার, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে মনিটরিং বৃদ্ধি করার ফলে প্রতিনিয়ত এই স্টেশনের রাজস্ব আদায় বাড়ছে। নভেম্বর মাসে এই স্টেশনে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের নভেম্বরে প্রায় ৪১ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। ফলে শুধু নভেম্বর মাসে এই স্টেশনের রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১১ শতাংশ। আমদানি-রফতানির এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে বলে মনে করেন স্টেশন সংশ্লিষ্টরা।
সোনামসজিদ শুল্ক স্টেশন সূত্রমতে, এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে পাথর, ভুট্টা, ভুসি, চিড়া, কিছু মেশিনারিজ, পোলট্রি ফিড, ফ্লাইঅ্যাশ ও পেঁয়াজ আমদানি হয়। মৌসুমি ফল, যেমন কমলা, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফল আমদানি হয়। নেট মশারি, পাটের ব্যাগ, পাটের দড়ি, রাইস ব্রান অয়েল ও কিছু গার্মেন্ট পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়। তবে এ বন্দর দিয়ে আমদানি পণ্যের ৬৪ শতাংশই পাথর। ফলে পাথর থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
সোনামসজিদ শুল্ক স্টেশনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানির সঙ্গে বেড়েছে রাজস্ব আদায়। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রাজশাহী ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন এই শুল্ক স্টেশনে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। শুধু এই মাসে আদায় বেড়েছে সাত দশমিক ৪৮ শতাংশ। নভেম্বর মাসে এই স্টেশনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৭৩ কোটি চার লাখ টাকা, যার বিপরীতে আদায় হয়েছে প্রায় ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আবার চলতি অর্থবছরের নভেম্বর মাসে গত অর্থবছরের নভেম্বরের তুলনায় প্রায় ৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। অর্থাৎ শুধু নভেম্বর মাসে রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
হিসাবে আরো দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর অক্টোবর মাসে গত অর্থবছরের অক্টোবরের তুলনায় প্রায় ১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। অক্টোবর মাসে রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় ৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে; আদায় প্রবৃদ্ধি ১৫৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। গতবছরের আগস্টের তুলনায় এ বছর আগস্ট মাসে প্রায় ৩০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। আদায় প্রবৃদ্ধি ১৯৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় প্রায় ৯৬ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। আদায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ২৮১ কোটি ৬২ লাখ টাকা; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩২ কোটি টাকা বেশি। ৫ মাসে এই স্টেশনের আদায় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এই শুল্ক স্টেশনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে আমদানির পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। চলতি অর্থবছর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৬২৩ দশমিক ৫৫ মেট্রিক টন, যেখানে গত অর্থবছর একই সময়ে আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার ৭৭৫ দশমিক ১৬ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরের তুলনায় এই অর্থবছর আমদানির পরিমাণ বেড়েছে দুই লাখ ৯৩ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৩৯ মেট্রিক টন। গত পাঁচ মাসে এই বন্দর দিয়ে আমদানি বেড়েছে ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
অপরদিকে চলতি অর্থবছর এই স্টেশন দিয়ে রফতানি পণ্যের পরিমাণ কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পর্যন্ত এই স্টেশন দিয়ে মোট পণ্য রফতানি হয়েছে ১০ হাজার ২৯৯ দশমিক ৪৬ মেট্রিক টন, যেখানে গত অর্থবছর একই সময়ে পণ্য রফতানি হয়েছে ১৩ হাজার ৫২২ দশমিক ৯২ মেট্রিক টন। রফতানি কমেছে তিন হাজার ২২৩ দশমিক ৪৬ মেট্রিক টন। অর্থাৎ পাঁচ মাসে রফতানি কমেছে ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
আরো দেখা গেছে, ৫ মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৩৩৮ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ হাজার ৭১৫ মেট্রিক টন বেশি। পেঁয়াজ আমদানি বেড়েছে ১১৪ শতাংশ। ৫ মাসে তাজা ফল আমদানি হয়েছে ২৯ হাজার ৯৫১ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ হাজার ৯৯১ মেট্রিক টন বেশি। ফল আমদানি বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। টমেটো আমদানি হয়েছে ১৩ হাজার ৮৭০ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন বেশি। টমেটো আমদানি বেড়েছে ১৫৬ শতাংশ। তবে ভুট্টা আমদানি কমেছে। গত ৫ মাসে ভুট্টা আমদানি হয়েছে ৬৩ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৯ হাজার ৩৯৭ মেট্রিক টন কম। অর্থাৎ ভুট্টা আমদানি কমেছে ৫৯ শতাংশ। রাইস ব্রান আমদানি হয়েছে ৩২ হাজার ৭৯৪ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন কম। রাইস ব্রান আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ।
এ বিষয়ে সোনামসজিদ স্থল শুল্ক স্টেশনের উপ-কমিশনার বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে আমরা রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এই উদ্দেশ্যে কমিশনারের নির্দেশক্রমে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে রাজস্ব আদায়ে বিগত বছরের তুলনায় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ ই-পেমেন্ট নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে স্বচ্ছতার সঙ্গে নতুন গতি এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘এনবিআর অনুমোদিত সফটওয়্যার বিকম-এর ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং মডিউল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পণ্য চালানের গাড়ি এন্ট্রি এবং এক্সিট কার্যক্রম চালু করার ফলে পণ্য চালান দ্রুত প্রবেশ ও খালাস নিশ্চিত করা যাচ্ছে।
পর্যাফত জনবল পদস্থ করার ফলে দ্রুত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সময়ে সময়ে মতবিনিময়ের মাধ্যমে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের মাধ্যমে রাজস্ববান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। এছাড়া রাজস্ব ফাঁকি রোধে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। আমার টিম নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম করে। তার ফলও আমরা পাচ্ছি। সেজন্য নভেম্বর মাসের রাজস্ব আহরণ ও প্রবৃদ্ধি দুই-ই বেড়েছে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন