বাড়ির ভিতরে শকবাড়িয়া নদীর জোয়ারের পানি আসা যাওয়া করছে গত শনিবার থেকে। রাতের জোয়ারে ঘরের ভিতরে পানি ঢুকে যাচ্ছে। কখন কি হয় এই ভয়ে জোয়ারের সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তায় থাকছি। রাতে ঘুমানো যাচ্ছেনা। ভাটা নেমে গেলে ঘরের ভিতর কয়েকটি ইট দিয়ে চুলা তৈরি করে রান্না করা হচ্ছে। একবার রান্না করে সারাদিন সেই খাবার খেতে হচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে আছি। এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার হরিহরপুর গ্রামের পশুপতি মন্ডল।
একই গ্রামের কাজল মন্ডল জানান, যে কোনো দুর্যোগ আসলেই বাঁধ ভাঙে। সেই সঙ্গে কপাল পোড়ে আমাদের মতো গরিব মানুষের। আজ এখানে তো কাল ওখানে, বাঁধ ভাঙলেই সরতে হয়। সরতে সরতে এখন দাঁড়াবার জায়গা নেই।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে বাঁধ ভেঙে ভিটেহারা সীতা রানী মাহাতো জানান, ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। রান্না করার কোনো ব্যবস্থা নেই, খাবার পানির কষ্টে আছি। প্রসাব পায়খানা করার কোনো উপায় নেই। ছোটছোট বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষদের নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি।
জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাব পড়ার আগেই খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের শাকবাড়িয়া নদীর হরিহরপুর লঞ্চঘাটের পূর্বপাশের বাঁধ ভেঙে যায়। এর আগে ইয়াসের প্রভাবেও একই স্থান ভেঙে গিয়েছিল। সপ্তাখানেক আগে মেরামত কাজ শেষ করে ঠিকাদার। পরে শোনা যায় ৫০ লাখ টাকার কাজ ঠিকাদার ৩৫ লাখ টাকা চুক্তিতে স্থানীয় শ্রমিক সরদার আবুল কালামের কাছে বেঁচে দিয়েছেন। তিনি লাভের আশায় তড়িঘড়ি করে সেখানে কয়েকটি বালুর টিউব ফেলে দায় সারেন। বাঁধের দু’পাশের ঢালে মাটি দেওয়ার কাজ করার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি। সে কারণে নদীতে সামান্য পানি বাড়তেই ফের ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হরিহরপুর ও গাতিরঘেরী গ্রামের দুইশ’ পরিবার এলাকা।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরী ও হরিহরপুর গ্রামে দিনে দুই বার জোয়ারের পানি উঠা নামা করছে। পানিতে ভাসছে দুই গ্রামের দুইশ’ পরিবার। ওই এলাকার মানুষের ঘরের ভিতরে পানি যাওয়া আসা করছে। টিউবওয়েল ও শৌচাগার গুলো ডুবে গেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ রাস্তায় বসবাস শুরু করছে।
হিউম্যানিটি ফার্স্ট নামে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা মাহমুদুল হাসান জানান, এখানে বার বার বাঁধ ভাঙার মূল কারণ সঠিক সময়ে সঠিক পন্থা অবলম্বন না করা। গাতিঘেরীর যে স্থানে সম্প্রতি ভেঙেছে সেখানে এর আগে ইয়াসেও ভেঙেছিল। তখন এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটি মেরামত করে। ছয় মাস পরে ওই বাঁধ মেরামতে কর্তৃপক্ষ ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও দায়িত্বহীনতার কারণে মূল ঠিকাদার অদক্ষ শ্রমিকদের কাছে কাজ বেঁচে দেওয়ায় তারা যেনতেনভাবে কাজ করেছে সেখানে। ফলে সামান্য পানির চাপে সহজে ভেঙে ফের প্লাবিত হয়েছে দুটি গ্রাম।
উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারি ও দায়িত্বহীনতার কারণে অদক্ষ লোকজন কাজের অনুমতি পায়। তারা কাজের মূল নকশা অনুসরণ না করে টাকা বাঁচাতে ইচ্ছা মতো কাজ করে। ফলে যে কোনো দুর্যোগ এলেই বাঁধ ভাঙে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, পরপর কয়েকটি দুর্যোগের কারণে এলাকার বেশিরভাগ বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব বাঁধ স্থায়ীভাবে সংস্কারের জন্য বরাদ্দ অনুমোদন হয়েছে। ওই কাজ শেষ হলে আর ঝুঁকি থাকবে না।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বর্তমানে যে স্থানে বাঁধ ভেঙেছে সেখানে কাজ চলমান ছিল। এ অবস্থায় কেন ভাঙলো, এর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন