ইংল্যান্ড : ২৯৩ ও ২৪০ (৮০.২ ওভারে)
বাংলাদেশ : ২৪৮ ২৫৩/৮ (৭৮.০ ওভারে)
(চতুর্থ দিন শেষে)
শামীম চৌধুরী, চট্টগ্রাম থেকে : পাঁচ ওভার হাতে থাকতে স্ট্যাম্পের উপরের বেলস যখন দুই আম্পায়ার দিলেন ফেলে, তখন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম উঠল নেচে। ড্রেসিং রুমে ফেরার পথে সাব্বির-তাইজুল পেলেন দর্শকের অভিবাদন। প্রাকৃতিক আলোর স্বল্পতায় ফ্লাড লাইটের আলোয় প্রথম তিন দিনের মতো ৪র্থ দিনেও লাল বল ছড়িয়েছে আতঙ্ক, সেখান থেকে সূর্যের আলোয় ঝলমলে বাড়তি একটি সকাল যে উপহার পেল বাংলাদেশ দল। যে আলোয় উদ্ভাসিত সকালে আজ ইতিহাস রচনার হাতছানি বাংলাদেশ দলের। কারণ, অসম্ভবকে সম্ভব করার লড়াইয়ে ৪র্থ দিন শেষেও যে ম্যাচটি দেখাচ্ছে বাংলাদেশকে স্বপ্ন। বাংলাদেশের কাছে চরম শিক্ষা পেতে পেতে চতুর্থ দিনের শেষ বিকেল ম্যাচে ফিরে যুদ্ধ জয়ের ছকও যে আঁকছে ইংল্যান্ড। চতুর্থ দিনের শেষ বিকেলে সাব্বির-তাইজুল বীরত্বে ২৫ মিনিটের যুদ্ধ জয়টাই দিচ্ছে দারুণ কিছু’র হাতছানি। জয় থেকে এখন বাংলাদে ৩৩ রান দূরে, সেখানে ২ উইকেট দূরে দাঁড়িয়ে ইংল্যান্ড। ২টি মাত্র ভালো ডেলিভারি, ২টি ভুলÑবাংলাদেশের হাতের মুঠো থেকে ম্যাচ বের করতে এমন ছকই যে আঁকছে অ্যালিস্টার কুকের দল।
টেস্টে বাংলাদেশের ৭টি জয়ের মধ্যে ৫টি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, অন্য ২টি গেইল, ব্রাভো, স্যামুয়েলস, চন্দরপলদের বিদ্রোহে নড়বড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। টেস্টে এই প্রথম বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জয়ে ইতিহাস রচনার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দল। বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে লিডের অতীত আছে, আছে বিচ্ছিন্ন পারফরমেন্স। তবে ১৫ মাস পর টেস্ট প্রত্যবর্তনেই অন্য এক বাংলাদেশ হাজির, লড়াইটা দুলছে চারদিন পে-ুলামের কাঁটার মতো! ম্যাচটিকে যে দিতে পেরেছে বাংলাদেশ প্রকৃতই টেস্টে রূপ।
টেস্টে যে ৭টি জয় আছে বাংলাদেশের, সেখানে চতুর্থ ইনিংসে চেজ করে জয়ের সংখ্যা মাত্র ২টি। চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ ২১৫ রান তাড়া করে ৪ উইকেটে জেতার অতীত আছে বাংলাদেশের। তা ৭ বছর আগে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, গ্রেনাডায়। সেখানে চতুর্থ ইনিংসে ২৮৬’র টার্গেটের পেছনে ছুটে অনেকটাই হার্ডল পেরিয়েছে বাংলাদেশ। ২টি ভালো বল, ২টি ডিসমিসালÑরোমাঞ্চকর ৫ম দিনে এ শঙ্কা থাকছেই। তৃতীয় দিনের প্রথম ঘণ্টায় মাত্র ২৭ রানে শেষ ৫ উইকেট হারানোর অতীতটাও রাখতে হচ্ছে তাই মাথায়। তবে ৪৮ ঘণ্টা আগের ওই দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলে নতুন ইতিহাস রচনার সামনে দাঁড়িয়ে এখন সাব্বির, তাইজুল, শফিউল। ২ বছর আগে চতুর্থ ইনিংসে ১০১ চেজ করতে বাংলাদেশ দলের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছাড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩ উইকেটের জয়ে যার ৩২ মিনিটের হার না মানা লড়াই ছিল প্রেরণাদায়ক, সেই তাইজুল আছেন ব্যাটিংয়ে। হাতে মজুদ আছে ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অবিশ্বাস্য জয়ে নবম উইকেটে ৫৮ রানের পার্টনারশিপে অবদান রাখা শফিউল! টেস্ট অভিষেকে ফিফটি উদযাপনে (৫৯) ইংল্যান্ড বোলার-ফিল্ডারদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছাড়া সাব্বির রহমান রুম্মানের ১৭৮ মিনিটের প্রতিরোধ এখন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে এখন যুদ্ধ জয়ের আবহ।
সকালটা দারুণভাবে করেছে শুরু বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডকে ৩শ’র নিচে বেঁধে ফেলার যে ছক এঁকেছেন বাংলাদেশ কোচিং স্টাফ, সেই কৌশলেই আটকা পড়েছে সফরকারী দল। দিনের শুরুতে মাত্র ১৯ মিনিটের মধ্যে শেষ ইংল্যান্ডের অবশিষ্ট ইনিংস। দিনের ১০ম বলে স্টুয়ার্ট ব্রডকে রান আউট দিয়ে শুরু, দ্বিতীয় নুতন বল হাতে নিয়ে দ্বিতীয় ডেলিভারিতে গ্যারেথ বেটিকে এলবিডাব্লুতে শিকারে ইংল্যান্ডকে ২৪০ এ গুটিয়ে দিয়েছেন বাঁ-হাতি স্পিনার তাইজুল। শেষ ২ জুটিতে ইংল্যান্ডকে ১২’র বেশি যোগ করতে দেয়নি বাংলাদেশ। এমন একটি সকাল থেকে দারুণ কিছুর টনিক নিয়ে চতুর্থ ইনিংস শুরু করছেন ইমরুল, তামীম দু’ধরনের স্ট্র্যাটেজিতে। ইমরুল যেখানে বোলারদের উপর চড়াও, সেখানে বড্ড সাবধানী তামীম। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে দারুণ ব্যাটিংয়ে আগের ৯ ইনিংসে গড়ে যেখানে ৬৪.৭৭ রানে এই প্রিয় প্রতিপক্ষের বোলারদের একটু বেশিই সমীহ করেছেন তামীম গতকাল। এই বাড়তি সতর্কতার কারণেই তামীমের উপর চড়াও হয়েছে ইংল্যান্ড। মঈন আলীর রিভিউ আপিলে জিতে যাওয়ার ২ বল পরে সেই মঈন আলীর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সঁপে দিয়েছেন তামীম ফরোয়ার্ড শর্ট লেগের ফিল্ডারের হাতে (৯)। ৩৩ মিনিটের এই জুটির ৩৫-এ নেতৃত্ব দেয়া ইমরুল নট আউট থেকে যেতে পারেননি লাঞ্চে। লাঞ্চের ঠিক ৭ মিনিট আগে আদিল রশিদকে সুইপ করতে গিয়ে ফার্স্ট স্লিপে দিয়ে এসেছেন তিনি ক্যাচ (৪৩)।
কাঁটায় কাঁটায় ২০০ টার্গেট নিয়ে লাঞ্চের টেবিলে যখন বাংলাদেশ, তখন দিনের শেষ ২ সেশনে দারুণ কিছুই উঁকি দিয়েছে। তবে লাঞ্চের পরের সেশনটিই হতাশ করেছে বাংলাদেশ দলকে। এই সেশনে রান উঠেছে ঠিকই, তবে স্কোরশিটে ৯২ যোগ করতে এই সেশনে হারিয়েছে বাংলাদেশ ৩ উইকেট! ইংলিশ অফ স্পিনার গ্যারেথ বেটির দ্বিতীয় স্পেলে ইয়র্কার ডেলিভারিতে সুইপ শট নিতে চেয়ে করেছেন মুমিনুল (২৭) ভুলÑ আম্পায়ার ধর্মসেনার বিচারে নট আউট হয়েও বাঁচতে পারেননি, রিভিউ আপিলে জিতে ইংল্যান্ড করেছে উৎসব। লাঞ্চের ২০ মিনিট পর মুুমিনুলকে ফিরিয়ে দিয়ে যে হাসি হেসেছেন ৩৯ বছর বয়সী বেটি, সাড়ে ১১ বছর পর টেস্ট প্রত্যাবর্তনে সেই হাসি আরো চওড়া হয়েছে নিজের পরবর্তী ওভারে মাহামুদুল্লাহকে (১৭) এলবিডাব্লুতে ফিরিয়ে দিয়ে! তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় বলে মঈন আলীকে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে চেয়ে আত্মাহুতি দিয়ে চট্টগ্রাম টেস্টের খলনায়ক সাকিব কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্র করতে পারেননি। পার্টনারশিপের দাবিটাই যে মেটাতে পারেননি তিনি! সেই মঈন আলীর বলে উইকেটের পেছনে দিয়ে এসেছেন ক্যাচ (২৪)। স্কোরশিটে ১৪০ উঠতে উপরের সারির ৫ ব্যাটসম্যান ফিরে যাওয়ায় ম্যাচে যে অশনি সংকেত ছিল,সেই পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তোলার দায়িত্বটা নিয়েছেন মুশফিক-সাব্বির। ১২২ মিনিটের পার্টনারশিপে ৮৭ রানে ৬ষ্ঠ জুটি দারুণ কিছুর স্বপ্ন দেখিয়েছে। দ্বিতীয় দিনের শেষ বিকেলে মুশফিকুরের উইকেট পেয়ে অন্য আনন্দে মেতে উঠেছে ইংল্যান্ড, চতুর্থ দিনের শেষ বিকেলেও মুশফিকুরের মনোসংযোগে ধরাতে পেরেছে ইংল্যান্ড চিড়। বেটির তৃতীয় স্পেলে শর্ট লেগের ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন মুশফিক (৩৯)। তবে শুরুতে ভুলের পর ভুল করে, ৩৪ রানের মাথায় লাইফ পেয়ে দিনের শেষ বেলায় অন্য এক সাব্বির যেনো হাজির জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। বড় শট নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে যে ছেলেটির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু হয়েছে টি-২০ দিয়ে, সেই সাব্বির ধাপে ধাপে ওয়ানডে এবং টেস্ট মেজাজটা যেনো করতে পেরেছে রপ্ত। আদিল রশিদও মঈন আলীকে লং অন, লং অফের উপর দিয়ে ছক্কাটিকে অনেকে হয়তোবা আদর্শ টেস্ট মেজাজের প্রতিফলন দেখতে পাবেন না। তবে ইংল্যান্ড বোলারদের উপর তার চড়াও হওয়া ব্যাটিংয়েই রক্ষণাত্মক ফিল্ডিংয়ে বাধ্য করেছে ইংল্যান্ডকে। শেষ ঘণ্টায় ১৪ ওভারে রান উঠেছে মাত্র ২৭টি, ফ্লাড লাইটের আলোয় দিনের শেষ ৭ ওভারে রান সেখানে মাত্র ১৬। স্টুয়ার্ট ব্রডের ভয়ংকর সব ইয়র্কার এবং রিভার্স সুইং সামাল দেয়া এই কঠিনতম পর্বে প্রকৃতই টেস্ট যোদ্ধা সাব্বির। অভিষেক টেস্টে ফিফটিতে (৫৯) এখন পুরো দলটাই তার দিকে তাকিয়ে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে নুতন ইতিহাস রচনায় দলের সব দায়িত্বটাই তুলে দেয়া হয়েছে তার কাঁধে। ২০১৩ সাল থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টেস্টে অন্য এক বাংলাদেশ দলের অবির্ভাব দেখেছে বিশ্ব। নিউজিল্যান্ড, শ্রীলংকা, দ. আফ্রিকার সঙ্গে গর্বের ড্র ছাড়াও জিম্বাবুয়েকে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশের সেই সুখস্মৃতি থেকেও টনিক নিতে পারে বাংলাদেশ দল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন