দুর্নীতি একটি অপরাধ ঃ ‘অপরাধ’ বলতে শরীয়তের এমন আদেশ ও নিষেধ বুঝায় যা লঙ্ঘন করলে হদ্দ বা তা’যীর প্রযোজ্য হয়। ‘আল-মাওয়ারদী, আল-ওলায়াতুত দীনিয়া ফিল আহকামিস সুলতানিয়া, বৈরূত : ১৯৭৮, পৃ. ২১৯’ দুর্নীতি একটি অপরাধ, যে সম্পর্কে আল্লাহ হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) অথবা তা’যীর (দন্ডবিধি) দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। ‘ড. মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, মৌলিক সমস্যা সমাধানে ইসলামী আইন, প্রাগুক্ত’ শাস্তির মাত্রার দিক থেকে অপরাধ তিন প্রকার: (ক) হদ্দ এর আওতাভূক্ত অপরাধ: যেসব অপরাধের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে শাস্তি নির্ধারিত। যেমন: যিনা (ব্যভিচার), যিনা এর মিথ্যা অপবাদ (কায্ফ), চুরি (সারাকা), ডাকাতি (কাতউত তারীক), মাদক গ্রহণ (শুরবুল খাম্র) এবং ইসলাম ধর্ম ত্যাগ (ইরতিদাদ); (খ) কিসাস ও দিয়াতের আওতাভূক্ত অপরাধ: যেসব অপরাধের জন্য কিসাস (মৃত্যুদণ্ড বা অঙ্গহানী) অথবা দিয়াত (রক্তপণ) নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন: ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হত্যা এর অন্তর্ভূক্ত এবং (গ) তা’যীরের আওতাভূক্ত অপরাধ: আল্লাহ বা মানুষের অধিকার সংশ্লি’ যে সব অপরাধের জন্য শরীয়ত নির্দি’ কোন শাস্তি কিংবা কাফ্ফারা নির্ধারণ করে দেয়নি সে সব অপরাধের শাস্তিকে তা’যীর (অনির্ধারিত শাস্তি) বলে। ‘ড. আহমদ আলী, ইসলামের শাস্তি আইন, ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টার, ২০০৯, পৃ. ২৯’
তা’যীর অপরাধ ঃ তা’যীর পর্যায়ের অপরাধগুলোর মধ্যে দুর্নীতিসমূহ অন্যতম। ‘মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০১০, পৃ. ১৮১’ এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে, অন্যায় অপকর্ম থেকে অপরাধীকে বিরত রাখা। ‘সম্পাদনা পরিষদ, অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৬, পৃ. ৯৫’ আর ইসলামী শাস্তি আইনের উদ্দেশ্য হলো: ১. মানুষের মৌলিক বিষয়সমূহের সংরক্ষণ; ২. সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন এবং ৩. অপরাধীকে পবিত্রকরণ। ‘ড. আহমদ আলী, ইসলামের শাস্তি আইন, ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ২০০৯, পৃ. ৩২-৩৩’ হুদুদ ও কিসাস জাতীয় কয়েকটি অপরাধ ছাড়া অবশি’ সব অপরাধই তা’যীরী অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু দুর্নীতি তা’যীরের পর্যায়ের একটি অপরাধ সেহেতু এর শাস্তিও তা’যীরের অনুরূপ। ‘প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১২’ তা’যীরা শাস্তি হচ্ছে: অপরাধের ভিন্নতার কারণে শাস্তির ভিন্নতা হবেচ।
যেমন, (ক) হত্যা: ইসলামী ফৌজদারী আইনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তা’যীরের আওতায় কাউকে হত্যা করা সমীচীন নয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা এমন কাউকে বিনা অধিকারে হত্যা করো না, যার হত্যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন’। ‘আল-কুরআন, ৬ : ১৫১’ ইমাম ইবনু তাইমিয়া র. বলেন, ‘বিপর্যয় সৃ’িকারী আক্রমণকারীর মতই। যদি আক্রমণকারী হত্যা ছাড়া অবদমিত না হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে’। ‘ইবনু তাইমিয়া, আল-ফাতাওয়া, তা.বি.,খ. ২৮.২৪৭’ (খ) বেত্রাঘাত করা, (গ) বন্দী করা, (ঘ) নির্বাসন বা দেশ থেকে বহিষ্কার, (ঙ) শূলে চড়ানো, (চ) উপদেশ বা তিরষ্কার কিংবা ধমকদান, (ছ) অপমান করা, (জ) বয়কট, (ঝ) আদালতে তলব, (ঞ) চাকুরীচ্যুতকরণ, (ট) সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে রেদয়া, (ঠ) কাজ কারবারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, (ড) উপায় উপকরণ ও সম্পদ ন’ করা, (ঢ) সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং (ণ) আর্থিক দণ্ড আরোপ করা। ‘আল-কুরআন, ২ : ১৮৮’ আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পদ্ধতিতে ভক্ষণ করো না এবং শাসকদের সামনেও এগুলোকে এমন কোন উদ্দেশ্যে পেশ করো না যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তোমরা অন্যের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও।’৫৯
সুপারিশমালা ঃ বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে গোটা বিশ্বকে একটি এষড়নধষ ঠরষষধমব মনে করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংস্পর্শে এসে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ সৃ’ি হয়। ওগঋ, ডড়ৎষফ ইধহশ, টঝঅ পলিসি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি অনেক ঘএঙ দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে।
দুর্নীতিদমনে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব-কর্তব্য, ভূমিকা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘ঘুষ যদি টেবিলের উপরে উঠে যায় তা হলে আমার করণীয় কিছুই নেই, আর যদি নিচে থাকে তাহলে এক্ষুণি প্রতিরোধ করা সম্ভব’। বর্তমানে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘুষ, দুর্নীতির অবস্থান কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। তাই দুর্নীতি দমনে কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হলো: ১. দুর্নীতিমুক্ত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃ’ির লক্ষ্যে ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং তাকওয়ার (আল্লাহভীতি) ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন; ২. ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি ও কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন; ৩. রা’্রীয় পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সম্পূরক অধ্যায় চালু করা যেতে পারে; ৪. সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার মানদণ্ড রক্ষা করা উচিত; এ বিষয়ে লিখিত অঙ্গিকারনামা ও মৌখিক শপথ নেয়া উচিত যে, তিনি কোন পর্যায়ে নিজেকে দুর্নীতির সাথে জড়াবেন না; ৫. রাজনৈতিক পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন