সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থ পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

দেশে থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। বিগত অনেক বছর ধরেই তা চলছে এবং দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনোভাবেই অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনারও কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানসিয়াল ইন্টিগ্রিটি’র (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে অর্থ পাচার বেড়েছে। গত ৬ বছরে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। গড়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে, প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এ হিসেবে বলা যায়, গত ৬ বছরে দেশের প্রায় এক বছরের বাজেটের কাছাকাছি অর্থ পাচার হয়ে গেছে। এ এক ভয়াবহ ব্যাপার। জিএফআই’র প্রতিবেদনে টাকা পাচারের দুটি প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রফতানির মূল্য কম দেখানো। উল্লেখ্য, জিএফআই উন্নয়নশীল দেশেগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন রকম পরমর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে।

বিদেশে অর্থ পাচার বৃদ্ধির ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে দুর্নীতি সীমাছাড়া হয়ে গেছে। অবৈধ পন্থায় একশ্রেণীর মানুষ যে ফুলেফেঁপে উঠেছে, তা এই অর্থ পাচার থেকে বোঝা যায়। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ তারা দেশে রাখতে নিরাপদবোধ করে না। ফলে অবৈধভাবে তারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসতভিটা করে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করছে। কানাডার বেগমপাড়া এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম করা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে তারা স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছে। অনেকে দেশের ভিটামাটি বিক্রি করেও চলে যাচ্ছে। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তার জন্য যেমন অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে, তেমনি দেশের বাসযোগ্য পরিবেশের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তার জন্যও অর্থ পাচার করছে। এটা ভাবা যায় না, আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশ থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব অর্থ তারাই পাচার করছে, যারা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জন করছে। এর ফলে তীব্র আয় বৈষম্য যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি দেশের সিংহভাগ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। দেশে দারিদ্র্যের হার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে দেশের ৫.২ কোটি মানুষ চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে বোঝায়, তাদের অনেকে পুরোদিন অভুক্ত থাকে। অন্যদিকে, ৩১.৯ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ অর্থ সংকটের কারণে খাদ্য অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় খাবার কমিয়ে দিয়েছে। এ চিত্রের মধ্যেই দেশে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এসব অর্থ পাচারের সাথে যারা জড়িত তাদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম। গুটিকয়েক লোক অর্থ পাচার করে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছে। এসব অর্থ যদি দেশে রাখার ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠত। সমস্যা হচ্ছে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুর্নীতিবাজরা কোনোভাবেই দেশে রাখা নিরাপদ বোধ করে না। অর্থ রক্ষা করতে এবং নিজে বাঁচতে বিদেশে পাচার ও পাড়ি জামাচ্ছে। এর অন্যদিক সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা এবং অনেকেই দেশে অর্থ রাখা নিরাপদ মনে করছে না বলেই অর্থ পাচার হচ্ছে। একদিকে দুর্নীতি দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে অর্থ পাচার অর্থশূন্য করে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

আমরা ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার আশা করছি। দেশে যে হারে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে এবং এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, তাতে এসব লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে আবশ্যিকভাবেই কয়েকটি বিষয়ের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বৈষম্য হ্রাস এবং বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এসব মৌলিক উপাদানগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাহত হতে পারে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা গতিশীল রাখতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে দেশের টাকা দেশে থেকে যায়। দুঃখের বিষয়, এ ধরনের পদক্ষেপ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি না পারছে অর্থ পাচার রোধ ও ফিরিয়ে আনতে, না পারছে নিজের চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে। দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অথচ তা রোধ করা যাচ্ছে না, এটা কোনোভাবে বরদাশত করা যায় না। অবৈধভাবে অর্থ পাচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ অর্থ পাচারকারীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। তারা ক্ষমতার প্রভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। অর্থ পাচার রোধে অবশ্যই পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন