শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভারতে পাচার হচ্ছে পিতল

হুমকিতে দেশীয় শিল্প কাঁচামালের অভাবে বাথরুম ফিটিংসের শত শত কারখানা বন্ধের পথে জাহাজ ভাঙায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে কিন্তু সুবিধা ভোগ করতে পারছে না

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের পিতল ভারতে পাচার হওয়ায় দেশীয় শিল্পকারখানায় উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে গেছে। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের (পিতল) অভাবে দেশের সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। প্রতিদিন দেশের কারখানাগুলোতে প্রায় ৫০ টন পিতলের চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে ও ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টন পিতল সংগৃহীত হয়। বাকিটা পূরণ হতো জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি জাহাজ ভাঙা থেকে পাওয়া পিতল চোরাইপথে ভারতে পাচার করছে। ফলে দেশের কারখানাগুলোতে পিতল সঙ্কট দেখা দিয়েছে; অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জাহাজ ভাঙা থেকে পাওয়া পিতলের টুকরো ভারতে পাচার বন্ধ না করলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হবেন; তখন বিদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানির করতে হবে বেশি দামে।
জানা গেছে, কতিপয় পিতল পাচারকারীর কারণে জাহাজ ভাঙা শিল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। বিশেষ করে জাহাজ ভাঙা এখান থেকে পাওয়া পিতল ভারতে চলে যাওয়ার কারণে দেশে গড়ে ওঠা পিতল নির্ভর কয়েক হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে চলেছে। সেখানে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক কর্ম হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। জাহাজ ভাঙায় বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিশাল এলাকায় নিয়ে গড়ে উঠেছে এ শিল্প। সেখানে সারা বিশ্বের প্রায় ৩৪ শতাংশ জাহাজ ভাঙা হয়েছে চলতি বছরে।
মূলত জাহাজের প্রপেলর, পাইপ, অন্যান্য যন্ত্রাংশ থেকে তামা ও পিতল বের হয়। সেই তামা বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সাইজ করে কেটে রপ্তানি করে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর প্রায় দুই থেকে তিন হাজার মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ পিতল ও তামা তারা পাচার করছে বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে। চট্টগ্রাম থেকে প্রতি কনটেইনারে ২০ টন করে পিতল রফতানি হয়। তবে ভারতে অবৈধভাবে পিতল পাচার হচ্ছে বেশি বলে জানা গেছে।
জাহাজ ভাঙা শিল্পের পিতলকে ঘিরে দেশের চাহিদা মেটাতে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে বাথরুম ফিটিংস কারখানা। এসব কারখানায় লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। দেশের অব্যাহত উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। প্রায় পাঁচ শতাধিক কারখানায় বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদিত হওয়ায় দেশ বৈদেশিক মুদ্রা খরচের কবল থেকে রক্ষা পায়, এসব কারখানার ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একটি চক্রের কবলে পড়ে তুলনামূলক বেশি দামের কারণে রফতানির নামে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে জাহাজ ভাঙা শিল্পের পিতল। যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে দেশে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো। এসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে দেশের মানুষকে বিদেশ থেকে বেশি দামে পণ্য ক্রয় করতে হবে, সরকারেরও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থমকে যাবে।
পরিবেশের জন্য ঝুঁকি সত্তে¡ও দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটনো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জাহাজ ভাঙার অনুমতি দেয় সরকার। পরিবেশবাদীদের তীব্র চাপ উপেক্ষা করে যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্য বিশ্বের আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন হিসেবে বদনাম নিতে হয়েছে, তার সুফল ভোগ করছে হাতে গোনা কয়েকজন পাচারকারী।
প্রতিদিন দেশের কারখানাগুলোতে প্রায় ৫০ টন পিতলের চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে ও ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টন পিতল সংগৃহীত হয়। বাকিটা পূরণ হতো জাহাজ ভাঙাশিল্প থেকে। ঢাকার নলখোলা, বিসিক, মিডফোর্ড, বেচারাম দেওড়ি, নয়া বাজার, ধোলাইপাড়, ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকায় পিতলের হাজারখানেক স্থানীয় ক্রেতা রয়েছেন। ডলারের দামের উপর নির্ভর করে পিতলের বাজারদর। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বাড়লেই কয়েকজন রফতানিকারক বেশি লাভের লোভে জাহাজ ভাঙা পিতলের সঙ্গে স্থানীয় বাজার থেকেও সংগৃহীত পিতল ভারতে পাচার করছে।
কারখানা চালু রাখতে চড়া দামে পিতল ক্রয় করে কম দামে পণ্য করতে বাধ্য হচ্ছে মালিকরা। লাগাতার ক্ষতির মুখে পড়ে অধিকাংশ বাথরুম ফিটিংস কারখানা বন্ধের পথে। গত বছর এ সময় দেশের বাজারে পিতলের দাম কেজি প্রতি ৩২০ টাকা থাকলেও এবার তা ৪৯০ টাকা কেজি। কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি, ফলে কারখানা মালিকরা আস্তে আস্তে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।
দেশে গড়ে ওঠা পিতলনির্ভর কারখানার মালিকরা আগে দেশের চাহিদা পূরণ করার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি তুলে আসছেন। তারা বলেন, সহনশীল দামে পিতল পাওয়া গেলে দেশে গড়ে ওঠা বৈদ্যুতিক তার, বাথরুম ফিটিংস ও ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরির কারখানাগুলো আরও সৃমদ্ধ হবে। এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। একই সঙ্গে এসব কারখানা থেকে সরকার বিপুল রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমের দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারবে। কিন্তু মুষ্টিমেয় কয়েকজন রফতানিকারক ও পাচারকারীদের কার সাজির ফলে তারা নিজেরা লাভবান হলেও দেশের বৃহৎ ক্ষতি হচ্ছে। তারা অবিলম্বে দেশের চাহিদা পূরণ না করে বাইরে পিতল রফতানি ও পাচার বন্ধের আহ্বান জানান।
শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয়েছে ১২০টি। এর মধ্যে ৪১টি (৩৪ শতাংশ) ভাঙা হয়েছে বাংলাদেশে। আর ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয়েছিল ১৭০টি। যার মধ্যে বাংলাদেশে ভাঙা হয়েছিল ২৪টি। জাহাজ ভাঙায় বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জাহাজ ভাঙায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এর আগে প্রথম দুই প্রান্তিকেও (জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন) শীর্ষে ছিল ঢাকা। জাহাজ ভাঙা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করা বেলজিয়ামভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা শিপ ব্রেকং প্ল্যাটফর্মের সবশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয়েছে ১২০টি। যার মধ্যে ৪১টি বা ৩৪ শতাংশ ভাঙা হয়েছে বাংলাদেশে। আর ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে জাহাজ ভাঙা হয়েছিল ১৭০টি। যার মধ্যে বাংলাদেশে ভাঙা হয়েছিল ২৪টি। ওই সময় মাত্র ১৪ শতাংশ ভাঙা হয়েছিল বাংলাদেশে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৫৮২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ভাঙা হয় ১৯৭টি বা প্রায় ৩৪ শতাংশ। আর ২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৩৩৪টি। তার মধ্যে বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলোয় ভাঙা হয়েছিল ৯৮টি বা ২৯ শতাংশ। সেই হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা বেড়েছে ৯৯টি।
শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্য মতে, গত বছর প্রথম ৯ মাসে জাহাজ ভাঙায় শীর্ষে ছিল ভারত। তবে চলতি বছর দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে গেছে দেশটি। ওই সময় দেশটিতে জাহাজ ভাঙা হয়েছে ১৫৫টি। এ ছাড়া চলতি বছর প্রথম ৯ মাসে পাকিস্তানে জাহাজ ভাঙা হয়েছে ৮৭টি, তুরস্কে ৬৭টি, চীনে পাঁচটি ও ইউরোপসহ বিশ্বের বাকি দেশে ৭১টি। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৬৩০টি। এর মধ্যে ভারতে ভাঙা হয়েছে ২০৩টি, বাংলাদেশে ১৪৪টি, পাকিস্তানে ৯৯টি, তুরস্কে ৯৪টি, চীনে ২০টি ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬০টি। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৬৭৬টি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই ভাঙা হয়েছিল ২৩৬টি। এ ছাড়া ভারতে ২০০টি, তুরস্কে ১০৭টি, পাকিস্তানে ৩৫টি, চীনে ২৯টি ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬৯টি জাহাজ ভাঙা হয়।
গত বছর বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙার পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ৫৮ লাখ ৬৬ হাজার ৭০৪ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙার পরিমাণ ছিল ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭৪ টন। এতে পরিমাণের দিক থেকে টানা ছয় বছর শীর্ষস্থান ধরে রাখে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে রডের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই জাহাজ ভাঙা বাড়ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের ইনকিলাবকে বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ চলছে। পাশাপাশি আবাসন খাতেও মন্দা কাটতে শুরু করেছে। এর প্রভাবে দেশে রডের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্পেও লোহার ব্যবহার বাড়ছে। এ চাহিদা পূরণে অন্যতম ভূমিকা রাখে জাহাজ ভাঙা শিল্প। তিনি বলেন, জাহাজ ভাঙায় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানে উঠে আসার কারণ হলো ইস্পাতের কাঁচামাল জোগানে নির্ভরতা। ভারতে ইস্পাত তৈরির মূল কাঁচামাল আকরিক আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Hafiz Enamul ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:৪৫ এএম says : 0
Very bad news for us
Total Reply(0)
মোহাম্মদ রমিজ ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:৪৬ এএম says : 0
অবিলম্বে পিতল পাচার বন্ধ করা হোক।
Total Reply(0)
মামুন রশিদ চৌধুরী ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:৪৬ এএম says : 0
এই চোর রাষ্ট্রটা বাংলাদেশের ভালো কিছু রাখবে না, চুরি করেই ছাড়বে।
Total Reply(0)
নিজাম ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:৪৭ এএম says : 0
কড়া নজরদারির মাধ্যমে পিতল পাচার বন্ধ করা হোক, দেশীয় শিল্প বাচানো হোক।
Total Reply(0)
Liakat ali ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:২৭ পিএম says : 0
অনতিবিলম্বে এই পাচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন