ভূরাজনৈতিক জটিলতার আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বাংলাদেশ। আয়তনে একটি ছোট রাষ্ট্র হলেও ১৭ কোটি লোকের বিশাল জনগোষ্ঠি এবং ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে তিনটি বৃহৎ শক্তির নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এই তিনটির মধ্যে একটি হলো এই মুহূর্তের পরাশক্তি আমেরিকা। দ্বিতীয়টি হলো উদীয়মান পরাশক্তি চীন। আর তৃতীয়টি হলো এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি ভারত। চলতি শতকের শুরুর পূর্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমেরিকার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। ৯০ দশকের অব্যবহিত পূর্বে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব ছিল তখন ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রীর কারণে বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রহ ছিল। ৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন খন্ড বিখন্ড হয় এবং সোভিয়েতের উত্তরসূরি হিসেবে আবির্ভূত হয় রুশ ফেডারেশন বা রাশিয়া। পরাশক্তির মর্যাদা হারানোর পর বাংলাদেশের ওপর রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক আগ্রহ হ্রাস পায়। তবে দেশটি অর্থনৈতিক কারণে রূপপুর প্রকল্পসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা সীমিত মাত্রায় অব্যাহত রেখেছে।
যে পটভ‚মিকায় ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, সেই পটভ‚মিকার কারণেই জন্মের শুরু থেকেই বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সর্বাত্মক ইন্টারেস্ট বা আগ্রহ অব্যাহত থাকে। ১৯৭৫ সালের দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে। এই ২১ বছরে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রবল প্রতাপ অনেক হ্রাস পায়। যে মাত্রায় ভারতের প্রভাব হ্রাস পায়, সেই মাত্রায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পায়নি। হতে পারে, তখনো চীন এখনকার মতো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি এবং উদীয়মান পরাশক্তির মর্যাদা পায়নি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে আবার ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। শেখ হাসিনার প্রথম ৫ বছরেও ভারত ট্রানজিট বা করিডোর এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর সুবিধা পায়নি। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতীয় প্রভাব আবার হ্রাস পায়। এক-এগারোতে জেনারেল মইন পর্দার অন্তরাল থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে ভারতের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে।
ভারতের পরলোকগত প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় রচিত ‘দি কোয়ালিশন ইয়ার্স’ গ্রন্থে প্রণব বাবু স্বীকার করেছেন যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট থাকাকালে শেখ হাসিনার কারামুক্তি এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ভারত কীভাবে চেষ্টা করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আবার ভাটা পড়ে।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারতীয় উপমহাদেশের চালচিত্র সম্পূর্ণ বদলে যায়। এটি যে সে পরিবর্তন নয়, একেবারে ৩৬০০ বাঁক নেয়। ভারত ১৯৫০ সাল থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে স্থল ও নৌ ট্রানজিট চেয়ে আসছিল এবং ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার আবদার জানিয়ে আসছিল। সুদীর্ঘ ৬০ বছর পরেও তারা সেই সুবিধা পায়নি। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরবর্তী বছরগুলোতে ভারতের ৬০ বছরের চাহিদাসমূহ একে একে পূরণ করা শুরু হয়। ভারতকে করিডোর এবং ট্রানজিট দেওয়া হয় এবং মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধাও দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় যে সুবিধা আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে দেয়, সেটি হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন।
ভারত যখন অব্যাহতভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট থেকে অফুরন্ত সুবিধা পাচ্ছিল, তখন চীনও বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তবে চীন বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তার অবস্থান বাংলাদেশকে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সাহায্য-সহায়তা প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঠিক একই সময় আমেরিকাও বাংলাদেশের ওপর নজর দেয়া শুরু করে। এই সময় বা তার কিছুটা আগে বিশ্বের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চ ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আংশিক অপসারিত হয়। বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত প্রভাবে বোধগম্য কারণে গ্রহণ লাগে সত্য, কিন্তু এই মধ্যবর্তী সময়ে অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন অবিশ্বাস্য অগ্রগতি সাধন করে। অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি এই উভয় ক্ষেত্রে চীন যতই অগ্রগতি সাধন করে ততই তার নজর বিশ্ব রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। একটি দেশ যখন অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধন করে তখন সামরিক শক্তি অর্জন তার কাছে সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘটনা ঘটেছে চীনের ক্ষেত্রে।
আজ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ শক্তি হলো আমেরিকা। দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হলো চীন। অর্থনীতিতে রাশিয়ার স্থান বর্তমানে অনেক নিচে। সামরিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হলো আমেরিকা। দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র হলো রাশিয়া। তৃতীয় ও চতুর্থ রাষ্ট্র হলো যথাক্রমে চীন এবং ভারত। আগামী দশ বছরের মধ্যে অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির জোরে চীন রাশিয়াকে টপকে পরাশক্তি হবে বলে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
চীনের এই উত্থানের গতি আমেরিকা তার হিসাব ও বিবেচনায় সর্বক্ষণ রাখছে। সে বিলক্ষণ বুঝতে পারছে যে, আগামীতে বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রবল প্রতিদ্ব›দ্বী হবে চীন। এজন্য এখন থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনকে প্রতিহত করার সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অখন্ডনীয় থিওরি হলো এই যে, যাদের নৌ শক্তি যত প্রবল, যারা সমুদ্রকে যত বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তারা ততো বেশি বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করবে। এক্ষেত্রে আমেরিকা এখনো অপ্রতিদ্ব›দ্বী নৌ শক্তি। আর সাত সমুদ্রের মধ্যে এখন প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র হলো ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশি। এক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব অসাধারণ। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী তিনটি দেশ হলো ভারত, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার। রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে মিয়ানমার রয়েছে চীনের সাথে।
ঐ দিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে বিপুল শক্তি অর্জনের পর চীনও এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। ভারতের সাথে তাদের সুদীর্ঘ সীমান্তে অন্তত চারটি স্থানে চীনের রয়েছে বিরোধ। এই চারটি স্থান হলো লাদাখ, হিমাচল, অরুণাচল এবং সিকিম। এই বিরোধ এতদিন সুপ্ত ছিলো। কিন্তু গত ৪ বছর থেকে এই বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিক থেকেই আমেরিকার ভারততোষণনীতি শুরু হয়। বারাক ওবামার সময় সেটি ঘনীভ‚ত হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো ভারতকে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশকে ভারতের হেফাজতে তুলে দেন। আমেরিকার ভারততোষণের কারণ হলো চীনকে ঠেকা দেওয়া। কারণ, সুদূর আটলান্টিকের ওপারে অর্থাৎ সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে এসে চীনকে এনসার্কেল করা বা ঘেরাও করা সম্ভব নয়। এ জন্যই তারা স্থানীয় শক্তি হিসেবে বেছে নিয়েছে চীনের চির প্রতিদ্ব›দ্বী ভারতকে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই জোট নিরপেক্ষতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ভারত তৎকালীন সোভিয়েত ব্লকে শামিল হয়। ভারতের সামরিক ভান্ডার প্রধানত সোভিয়েত অস্ত্রে পূর্ণ। কিন্তু ৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের খন্ড-বিখন্ড হওয়ার পর বিল ক্লিনটন যখন ভারতকে আমেরিকার কোলে টানার চেষ্টা করেন, তখন ভারত তাতে সাড়া দেয়। বারাক ওবামা ভারতকে মার্কিন অস্ত্র দেওয়া শুরু করেন। এখন ভারতের অস্ত্র সংগ্রহের উৎস বহুমুখী। রুশ অস্ত্র সরবরাহ তো আছেই, উপরন্ত আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ইসরাইল থেকেও ভারত অস্ত্র সংগ্রহ করছে। চীনকে ঠেকানোর তাগিদ তাদের এত প্রবল যে, এতদিন ধরে তারা বাংলাদেশকেও ভারতের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছিল।
কিন্তু হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশকে শর্তহীনভাবে ভারতের জিম্মায় ছেড়ে দিতে রাজি নন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ চীনকে ঠেকানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এশিয়ায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর আমেরিকার কাছে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও ভূস্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব দারুণভাবে বেড়ে গেছে। বাইডেন আমলে বাংলাদেশ-ভারত সখ্য মেনে নিলেও বাইডেন ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে চান না। ভায়া ভারত না হয়ে আমেরিকা বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখতে চায়। এজন্যই ট্রাম্পের আমলের শেষদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ে ফোন করেছিলেন এবং সরাসরি অস্ত্র সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে নিরুত্তর থাকে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ ব্যাপারে আরো একধাপ এগিয়ে আছেন। তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএসের অধীন কোয়াডে বাংলাদেশকে চান।
এদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলে যাওয়ায় এবং চীন বিরোধী জোটের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় চীনও বাংলাদেশকে তার সাথে চায়। এজন্য চীন বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগদানের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। একই সাথে চীনও বাংলাদেশকে তোষণ করেছে। বাংলাদেশে কর্মরত চীনা রাষ্ট্রদূত যে বার্তা দিয়েছেন সেই বার্তা চীনের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। ঐ বার্তায় চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে সে ব্যাপারে আমেরিকার যেমন সতর্কতা, তেমনি ভারতও অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মার্কিন শিবিরে গেলে ভারতের আপত্তি নাই। কিন্তু তাই বলে ভারত চায় না যে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়–ক। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে নিয়ে তিন বৃহৎ শক্তির টানাটানি শুরু হয়েছে। ভ‚রাজনীতি এবং ভূস্ট্র্যাটেজির জটিল আবর্তে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। টান টান রশির উপর সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে বাংলাদেশকে।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন