পূর্ব-পশ্চিমের দ্বন্দে গত ৫ দশক ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ দুই বড় পরাশক্তির আঁতাতের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সত্তুরের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও রোহিঙ্গা সংকটে সেই আঞ্চলিক ভ’রাজনীতির মিথস্ক্রিয়া বিদ্যমান রয়েছে। নানা নাটকীয় ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ পরনতি কি হবে এই মুহূর্তে তা প্রিডিকশন করা প্রায় অসম্ভব। তবে এটুকু অবশ্যই আন্দাজ করা যায়, এই যুদ্ধে রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক ও কৌশলগত বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। তবে ৬ দশক ধরে তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা, একচীন নীতির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার ও সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানিমূলক সামরিক, ক’টনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতাকে মার্কিনীদের কৌশলগত ভ’মিকা হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। এর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদার ও পরাশক্তির মধ্যে আঁতাতের দৃষ্টান্তও রয়েছে। সেই ম্যাকার্থিজমের যুগ থেকে চলমান ইউক্রেন সংকট পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দে চীন নিজের গা বাঁচিয়ে অর্থনৈতিক আখের গুছিয়ে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়েছে। বিগত শতাব্দীর সত্তুরের দশকে বিশ্বের ৮ বা ৯ নম্বর অর্থনীতি থেকে চীন এখন এক-বা দুই নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়েছে। আগামী দশকের শেষে চীনা অর্থনীতির আকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। যখন মার্কিন ম্যানুফ্যাক্চারিং খাত ক্রমশ চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দিতায় মার খাচ্ছে, ভ’-রাজনৈতিক দ্বন্দ এক সময় বাণিজ্যযুদ্ধে রূপ লাভ করছে। দুই দেশ পরস্পরের পণ্যের উপর ট্যারিফ ব্যারিয়ার সৃষ্টি করেও যখন উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তখন উভয়ে গোফ নামিয়ে সুর নরম করতে বাধ্য হচ্ছে। চীনের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অটুট থাকেনি। জোবাইডেন সে যুদ্ধের লিগ্যাসি ধরে রাখতেই নারাজ। পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার নাজুক অবস্থায় চীন বড় ধরণের ঝুঁকি নিচ্ছে না। রাশিয়ার আক্রমনে ইউক্রেন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো-ইউরোপীয় সামরিক-অর্থনৈতিক জোট যখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইজ্জত বাঁচাতে চাইছে, তখন ডনবাস এলাকায় রেফান্ডামে রাশিয়ার কৌশলগত বিজয় ও পারমানবিক যুদ্ধের হুমকি সেখানে বড় ধরণের সংকট সৃষ্টির আলামত দেখা দিয়েছে। জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে সামরিক নিরাপত্তা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ পরিনতি যাই ঘটুক, এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত পরিনতি ডেকে আনতে পারে। বিশাল রাশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার পারমানবিক বোমা ও পারমানবিক সাবমেরিণে রক্ষিত আইসিবিএমগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ পূর্বের যে কোনো যুদ্ধের চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক পরিনতি ডেকে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কতটা ঝুঁকি গ্রহণ করবে তার একটা সীমারেখা নিশ্চয়ই আছে। ন্যাটো ইতিমধ্যেই প্রকারান্তরে ইউক্রেনে তাদের সামরিক-কৌশলগত পরিকল্পনা থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এহেন বাস্তবতায়, ইউরোপ ও এশিয়ায় রাশিয়ার প্রধান গ্যাস সরবরাহ লাইন নর্ড-১ ও নর্ড ২ পাইপলাইন অবকাঠামোতে নাশকতামূলক বিষ্ফোরণ পুরো পরিস্থিতিকে একটি জটিল আবর্তে ঠেলে দিয়েছে।
খারকিভ এলাকায় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বড় ধরণের সামরিক পরাজয়ের পর ভøাদিমির পুতিনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের কণ্ঠে নাকি কিছুটা তিরষ্কারের সুর শোনা গেছে। সাংহাই কোঅপারেশন চুক্তির আওতায় চীন-রাশিয়া ভূরাজনৈতিক ও সামরিক-অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র যে কোনো সময় পশ্চিমা একাধিপত্যের পতন নিশ্চিত করতে পারে বলে যে সব রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ রয়েছে তা মোটেও অমূলক নয়। কিন্তু বড় ধরণের সামরিক-অর্থনৈতিক ঝুঁকি সত্বেও ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিখন্ডী হিসেবে দন্ডায়মান রয়েছে তখনো চীন শান্তি ও মধ্যস্থতার বার্তা নিয়ে মূলত একটি ফলাফল নির্ধারণী শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে চীনসহ অন্তত ৬৬টি দেশ কোনো পক্ষে না গিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহŸান জানিয়েছে। দুই পক্ষের মারামারিক মাঝখানে সম্ভবত এটিই এখন বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো মতামত। কিন্তু একদিকে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্র বাণিজ্য ও ওয়ার কন্ট্রাক্টরদের স্বার্থের বাইরে চীনের মত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি এই যুদ্ধ থেকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের মওকা খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায়। ষাটের দশকের প্রথমদিকে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অনিবার্য পারমানবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। তবে একটি পারমানবিক যুদ্ধের ফলাফল কি হতে পারে তা কারো অজানা নয়। কিউবার ভিন্ন মতাবলম্বীদের ব্যবহার করে মার্কিন সামরিক গোয়েন্দারা কিউবার ‘পিগস বে’ উপকুল দখলে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পর ফ্লোরিডা থেকে মাত্র আশি মাইলের মধ্যে থাকা কিউবায় সোভিয়েত পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েনের বিপদ আঁচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতালি ও তুরস্ক থেকে কৌশলগত জুপিটার ক্ষেপনাস্ত্র প্রত্যাহার এবং কিউবার উপর অনাক্রমন চুক্তির মধ্য দিয়ে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের অবসান ঘটে। যার যার ক্ষেপনাস্ত্র ঘরে ফিরিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে সে যাত্রায় পারমানবিক হুমকির অবসান ঘটে। সেখানে তৃতীয় কোনো শক্তির স্বার্থ বা প্রভাব কাজ না করলেও এবার ইউক্রেন সংকটে চীনের নেপথ্য পরিকল্পনা বড় ধরণের ভ’মিকা রাখতে চলেছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, যুদ্ধের ফলাফল ও গতিপ্রকৃতি এখন আর পশ্চিমাদের হাতে নেই। চীন-রাশিয়া, ইরান-তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ভ’মিকা নিজেদের পক্ষে এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭০এর দশকের পর আবারো চীন-মার্কিন আঁতাতের একটি আশঙ্কা তুলে ধরেছেন কেউ কেউ।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। স্থায়ী শত্রæ বা মিত্র বলেও কিছু নেই। দেশে দেশে এবং বিশ্বরাজনীতিতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সমঝোতার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ফিরে আসার বাস্তবতাকে বলা হয় ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সমঝোতা বা রিকনসিলিয়েশন যেমন বড় ধরণের বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি থেকে রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখতে পারে, আবার দেশে দেশে ও আঞ্চলিক সংঘাতের বাস্তবতায় ক’টনৈতিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার পথ অনেক বড় বড় যুদ্ধের আশঙ্কা দূরিভুত করার অসংখ্য উদাহরণ আছে। মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এক ধরণের ভীতি বা ফোবিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে বিপুল চীনা ও বংশোদ্ভুত নাগরিকের উপস্থিতি সেখানকার কট্টরপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যে ‘লালফৌজ ভীতি’ দেখা দিয়েছিল। যেখানেই সন্দেহ তো সেখানেই হাত দিয়ে সম্ভাব্য কমিউনিষ্টদের চাকুরিচ্যুত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতারিত করার নীতিগত ফর্মূলাটির উৎগাতা ছিলেন কট্টরপন্থী রিপাবলিকান সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থার। এ কারণে কমিউনিস্ট বিতারনের এই কর্মযজ্ঞ ম্যাকার্থিজম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। চীনা সোভিয়েত কমিউনিস্ট প্রভাবের সন্দেহভাজনদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হননি। রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে নানা প্রকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছিল। চীনের উপর প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের সময়কার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পর সত্তুরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চীনের রাজনৈতিক দ্বন্দ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে সফল হয়। ১৯৬৯ সালে চীনের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। তাইওয়ান প্রণালিতে মার্কিন নৌবাহিনীর টহলদারি স্থগিত করা হয়। চীনের সাথে মার্কিনীদের সম্পর্কোন্নয়নের এসব ক’টনৈতিক ঘটনাক্রম পিংপং ডিপ্লোম্যাসির ফল বলে পরিচিতি লাভ করে। ভিয়েতনামে মার্কিনীদের পরাজয় মার্কিনীদের চীনের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনার পাশাপাশি স্ট্রাটেজিক আর্মস লিমিটেশন টক বা দুই দফা সল্ট ডায়ালগের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সামরিক উত্তেজনা কমিয়ে আনার উদ্যোগ সফল হয়েছিল। এভাবেই একেকটি যুদ্ধের পর বা যুদ্ধের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মুখে শান্তির নতুন সম্ভাবনা জেগে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি মানুষের মৃত্যু এবং পারমানবিক সমরাস্ত্রের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা না ঘটলে মানুষের মধ্যে এমন যুদ্ধ বিরোধি মনোভাব এবং জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম হতো না। এবার ইউক্রেনে রাশিয়া ও আমেরিকার মুখোমুখী অবস্থান বিশ্বকে এক নতুন হুমকির মথে দাঁড় করিয়েছে। এখানে তৃতীয় অনুঘটক শক্তি হিসেবে চীনের ভ’মিকা অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। ইউক্রেন ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার কোনো আশঙ্কা না থাকলেও রাশিয়ার আশঙ্কা প্রবল। তবুই প্রক্সি যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে শত শত কোটি ডলার খরচ করেছে। একটি সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দাকে সামনে রেখে এই যদ্ধব্যয় অব্যাহত রাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। সেখানে দুই পক্ষের একটি উইন-উইন বা সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে চীন অনুঘটকের ভ’মিকা পালন করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। নাইন-ইলেভেন পরবর্তি ওয়ার অন টেররিজম এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়া যুদ্ধের পর ইউক্রেন ঘিরে চলমান বাস্তবতায় ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত আঁতাতের লক্ষ্য ও কার্যকারিতা হারিয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা। সাংহাই কো-অপারেশন সংস্থার কমিটমেন্ট সত্তে¡ও চীন এখনো ইউক্রেনে রাশিয়ার সাথে গাঁটছড়া বাঁধেনি। তাদের কণ্ঠে ক’টনৈতিক সমঝোতার সুর। এখান থেকেই চীনের বিশ্ব নেতৃত্বের নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। বিশেষত তাইওয়ান ও দক্ষিন এশিয়ায় চীনের আধিপত্য ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনে সামরিক-ক’টনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে।
রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন যেমন স্পর্শকাতর ইস্যু, একইভাবে তাইওয়ানও চীনের জন্য অগ্রাধিকার ও স্পর্শকাতর ইস্যু। এই দুই ইস্যুর মাঝখানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্রাইসিস, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবার্ধিকারের প্রশ্নসহ অনেক কিছুই উপেক্ষিত ও অগ্রাহ্য হয়ে পড়েছে। স্থান-কাল ভেদে কোনো ইস্যুই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইউক্রেনে-ইউরোপে রাশিয়া-আমেরিকার নিরাপত্তা ও ইজ্জত রক্ষায় আবারো যদি একটি চীন-মার্কিন আঁতাত হয় তাতে তাইওয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের কৌশলগত অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করার সুযোগ নিবে চীন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রশ্নে চীন-মার্কিন সমঝোতা হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। নাইন-ইলেভেন পরবর্তি বিশ্ববাস্তবতায় বিগত দশকে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে ইন্দো-মার্কিন সমঝোতা নেপথ্য ভ’মিকা সম্পর্কে অনেক কথাই প্রচলিত আছে। আফগানিস্তানে মার্কিনীদের পশ্চাৎপসারণ এবং ভারতীয়দের বিতাড়িত হওয়ার পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার উপর মার্কিন অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও রাশিয়া থেকে ভারতের জ্বালানি আমদানিসহ স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে ভারতের অবস্থান উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রশ্নে মার্কিনীদের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য করছে। ইন্দো-মার্কিন স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ সমঝোতার কারণে বাংলাদেশে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দিল্লীর স্বার্থে মার্কিনীরা নিরব দর্শকের ভ’মিকা পালন করলেও সম্ভবত এবার আর তা হচ্ছে না। কাশ্মীর এবং সিএএ প্রশ্নে সারাবিশ্বের নিন্দা ও সমালোচনা, চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে উপমহাদেশের প্রায় সবগুলো দেশই যখন ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখনো বাংলাদেশ ভারতের মুখ রক্ষা করেই চলেছিল। কিন্তু বড় প্রতিবেশি হিসেবে ভারত তার মর্যাদা রক্ষা ও দায়িত্ব প্রতিপালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তিস্তার পানিচুক্তিসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভারত যে নিষ্ঠুর আগ্রাসন ও তামাশা করছে তা এখন সারাবিশ্বে ওপেনসিক্রেট। এমনকি রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও ভারতের অবস্থান মিয়ানমার ও চীনের সাথে সহযোগিতামূলক। এখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, নদীশাসন ও খাদ্য নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কানেক্টিভিটির প্রশ্নে চীন-মার্কিন সমঝোতা হলে বিষ্ময়ের কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে নিজের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করেছে। পশ্চিমারা সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। বর্তমান অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন যে সম্ভব নয় তা অকাট্যভাবে প্রমানিত হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের তীব্র আপত্তি বিরোধিতা সত্তে¡ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে চীন। প্রকল্পে চীন প্রাথমিকভাবে ৮২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। তিস্তার পানি চুক্তিতে ভারতের অনীহা এবং নদ-নদীর নাব্য সংকট, নদী ভাঙ্গন, পানির অভাবে কৃষি ও জীব-বৈচিত্রে বিপর্যয় রোধ করে বাংলাদেশকে নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলতে চিনের অর্থায়ণ ও প্রকল্প সহায়তায় তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত না করে বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নের নামে লুটপাট আর টাকা পাচারের মচ্ছব জাতি আর দেখতে চায়না।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন