নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা-ময়দা, পেঁয়াজ-রসুন, আদা, আলু এসব জরুরি নিত্যপণ্যে দাম গত বছর ছিল লাগামহীন। ২০২১ সালে শুরু হয়েছিল নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দিয়ে এবং শেষও হয়েছে দাম বাড়ার মধ্য দিয়ে। এ জন্য গত বছরটাকে অনেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বছর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গত দুই বছর অর্থাৎ ২০২০ এবং ২০২১ সাল কেটেছে মহামারি করোনার সঙ্গে লড়াই করে। করোনা ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন এমনিতে চরম সঙ্কটে। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় মানুষের জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
বাজারে জিনিসপত্রের দামের উত্তাপে সারাবছরই দিশেহারা ছিল দেশের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এবার তাদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরা ভুগেছেন সমানভাবে। বাজার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা, বাসস্থান, বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোতে ব্যয় কমিয়েছেন দেশের জনসংখ্যার বড় একটা অংশ। ক্রেতাদের মতে, করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয়তো করোনাভাইরাস ঠেকানো সম্ভব; কিন্তু নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে রীতিমতো অসহায় তারা। অনেক ক্রেতা বলেন, তাদের আয়ের ৯০ শতাংশই এ বছর খরচ করেছেন বাসা ভাড়া ও বাজারে। আবার অনেকেই তুলনামূলক কম ভাড়ার বাসা নিয়েছেন এই বাড়তি ব্যয় মেটাতে। অনেকে সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
রিকশাচালক ইদ্রিস মিয়া বলেন, গত ১০/১২ বছর ধরে তিনি ঢাকায় আছেন। আগে একটি কোম্পানিতে পিয়নের চাকরি করতেন। পরিবার নিয়ে খিলগাঁয়ে থাকতেন। করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে এখন রিকশা চালাচ্ছেন। খিলগাঁয়ের বাসা ছেড়ে কম টাকায় গোড়ানে টিনসেড বাসা নিয়েছেন। ছয় সদস্যের পরিবার তার উপার্জনে চলে। রিকশা চালিয়ে যা আয় করেন তা দিয়ে চাল কিনলে তরিতরকারি মাছ কিনতে পারে না। এক ছেলে ও এক মেয়ে স্কুলে পড়ে। আগে তাদের একটা কোচিংয়ে দিয়ে ছিলেন। এখন তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। কোচিংয়ের খরচ আর চালাতে পারে না। চাল-ডাল এসবই চাহিদা মতো কিনতে পারছেন না। গত ছয় মাসের বেশি হবে বাসায় গোশত কিনে নিতে পারেননি। আগে মাঝেমধ্যে বয়লারের মুরগি কিনে নিতে পারতেন। তার দামও এখন আমাদের নাগালের বাইরে।
ইদ্রিস মিয়ার মতো নিম্ন-মধ্যবিত্তসহ অনেক মধ্যবিত্তও তাদের প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু তাই নয়, খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বড় একটি অংশ খাদ্য তালিকা থেকে আমিষের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। যা বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। এই খাদ্যের বেশিরভাগই চাল। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও তাদের ঘাড়ে চাপে বেশি।
২০২১ সালের বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালের ধারাবাহিকতায় ২১ সালের জানুয়ারি থেকেই চড়া ছিল নিত্যপণ্যের বাজার। যা শুরু হয় বছরের প্রথম সপ্তাহেই চাল ও তেলের দাম বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। তখন এক মাসের ব্যবধানে আরেক দফা বেড়ে ৫৫ টাকার মিনিকেট চাল ৫৮-৬০ টাকার মধ্যে এবং এক লিটারের সয়াবিন তেলে প্রায় ১৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছিল ১২৫ টাকা দরে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়ে ছিল চিনি, আদা, রসুনসহ সব ধরনের আমদানিকৃত পণ্যের দাম। এদিকে জানুয়ারি মাসে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির এমন প্রবণতা অব্যাহত থাকে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে হাসকি বা মোটা জাতের যে চালের দাম ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা কেজি, সে চালের দাম ডিসেম্বরে হয়েছে ৪৮ টাকা থেকে ৫২ টাকা কেজি। চিকন চাল বা নাজির শাইল চালের দাম বছরের শুরুতে ছিল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৪ টাকার মধ্যে, সে চালের দাম বছর শেষে হয়েছে ৬৪ থেকে ৭০ টাকা কেজি। এ ছাড়াও বছরজুড়েই চালের বাজার ছিল অস্থির। সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি করেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) ‘খাদ্যশস্য : বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ বাণিজ্য বছরে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে, যা চাল আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, গত ২০২১ সালের জুলাই থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৫ লাখ টন চাল দেশে আমদানি হয়েছে।
২০২০ সালে যে চিনির দাম ছিল ৫০ টাকা কেজি তা ২০২১ সালের শুরুতে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়। এরপর বছর শেষে এ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে। তখন ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। তারা তখন নতুন দাম নির্ধারণের জোরালো আওয়াজ তোলেন। চিনির দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি বিক্রি করেন ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ১ কেজির চিনির দাম নির্ধারণ করেন ৭৫ টাকা। কিন্তু বিগত ৭-৮ মাস ধরেই বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে চিনি।
ভোজ্যতেলের বাজার ছিল খুবই অস্থির। ২০২০ সালে ভোজ্যতেল প্রতি লিটার ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা লিটার বিক্রি হয়েছে। বছর শেষে সে তেলে দাম হয়েছে ১৬০ টাকা লিটার। সরকার ভোজ্যতেলের দামও ১৫২ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিয়েছে; কিন্তু তা কেউ মানছে না।
গত বছর মুসুর ডালের দামও ব্যাপক বেড়েছে। বছরের শুরুতে ডালের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। বছর শেষে তা হয়েছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা কেজি।
গেল বছর আটা-ময়দার দামও অনেক বেড়েছে। বছরের শুরুতে প্রতি কেটি আটার দাম ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা বছর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৪৫ টাকা কেজি।
২০২১ সালে ব্রয়লার মুরগির দামও অস্বাভাবিক বেড়েছে। বছরের শুরুতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে। বছর শেষে সেই মুরগি ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এভাবেই বছরজুড়ে বাজারে চলে অস্থিরতা। চাল, ডাল, চিনি, আটা, তেল, মুরগি, ছাড়াও পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডিমসহ অন্যান্য পণ্যের দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমা ছাড়িয়ে যায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান বাজার ব্যবস্থা ক্রেতাদের জন্য নয়, বিক্রেতাদের জন্য। সরকার বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ। অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে এমন হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো সৎসাহস কারও হচ্ছে না। মূলবিষয় হলো- সুশাসনের ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সুশাসন নিশ্চিত না হলে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাদের এ ব্যর্থতার কারণে একশ্রেণির সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বৃদ্ধি করছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। করোনার কারণে দেশে দেড়কোটি দরিদ্র বেড়েছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায় রাখতে না পারলে দরিদ্র মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন