নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। আগামী ১৬ জানুয়ারি নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীদের প্রচারণায় বন্দর নগরী এখন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ওয়ার্ডে পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন এবং ভোটারদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। পৌষের শীত উপেক্ষা করে চলছে জমজমাট প্রচার-প্রচারণা। চায়ের দোকান থেকে অফিস-আদালত সবখানেই আলোচনায় এখন নির্বাচন। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থনে নগরীর পাড়া-মহল্লার অলিগলি ও বিভিন্ন সড়কে চলছে মাইকিং। লিফলেট বিলিসহ করছেন গণসংযোগ, পথসভা ও উঠান বৈঠক। জমজমাট প্রচারণার মধ্যেও ভোটারদের মনে নানা প্রশ্ন। কে জিতবে? কে হারবে? ভোট দিতে পারবে তো? এমন নানা প্রশ্ন নিয়েই চলছে তুমুল আলোচনা। মেয়র প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগও তুলছেন। যার ফলে নির্বাচন নিয়ে দুই মেয়র প্রার্থীর কথার যুদ্ধে চলছে টানটান উত্তেজনা। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত নেতা শামীম ওসমান গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে সরব হওয়ার ঘোষণায় নির্বাচনী উত্তেজনা আরো বেড়ে গেছে।
একই সাথে তৈমূর আলম খন্দকারের নির্বাচনী সমন্বয়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে গতকাল আটক করায় উৎকন্ঠা এবং অতঙ্কও বাড়ছে। এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী পরিবেশ বেশ শান্ত ছিল। ভোটারদের মনে নির্বাচন নিয়ে ছিল উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা। তবে গতকাল স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের নির্বাচনী সমন্বয়ক ও জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে আটকের ঘটনায় ভোটারদের মনে আবারো উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
নির্বাচনের আর মাত্র হাতেগোনা ৫ দিন বাকি। এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অনেকটা শান্তিপূর্ণ থাকলেও সামনের দিনগুলোতে কি হয় তা নিয়ে ভোটারদের মনে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। মেয়র পদে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার প্রশাসনের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন।
নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭ জন প্রার্থী। তবে মূল লড়াইটা হবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কারণ দেশে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যেভাবে নৌকার ভরাডুবি হচ্ছে তাতে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে তারা বেশ সতর্ক। নারায়ণগঞ্জে নৌকার বিজয়ের ব্যাপারে তারা অনেকটা মরিয়া। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রতিদিনই আইভীর পক্ষে প্রচার প্রচারণায় অংশ নিতে নারায়ণগঞ্জে ছুটে যাচ্ছেন। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নিরসনেও তারা চেষ্টা করছেন। আইভীর পক্ষে কাজ না করায় মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতিসহ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে আলোচিত নেতা শামীম ওসমান এত দিন নীরব থাকলেও গতকাল তিনিও আইভীর পক্ষে নির্বাচনে নামার কথা ঘোষণা করেছেন। নৌকার প্রার্থী আইভীর পক্ষে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।
অন্যদিকে হাতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা স্বতন্ত্রপ্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষেও মাঠে রয়েছেন স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। এছাড়া জাতীয় পার্টির চার চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের নেতাকর্মী তৈমূরের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ কমিশনের অধীনে এটাই শেষ কোনো বড় নির্বাচন। অতীতের সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা ও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ায় বর্তমান ইসি সমালোচিত হচ্ছেন। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও নানা অনিয়মের ফলে সে সমালোচনার মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ সিটির নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করে নিজেদের ব্যর্থতার কালিমা কিছুটা হলেও লাগব করতে পারে। তবে বিশিষ্টজনদের এ নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে ন্যূনতম আস্থাও নেই। তারা মনে করেন এ নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন। তাদের পক্ষে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, এ নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। তাদের পক্ষে নির্বাচন সুষ্ঠু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে সরকার চাইলে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। সে রকম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এ অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই মেয়রপ্রার্থী এবং ভোটাররা কী ভাবছেন সে বিষয়ে কথা বলেছেন আমাদের নারায়ণগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা। তিনি তার প্রতিবেদনে জানান, নাসিক নির্বাচনের তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে ততই সরগরম হয়ে উঠছে সিটি কর্পোরেশন এলাকা। আওয়ামী লীগ মনোনীত ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার দু’জনেই জয়ের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যেও উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি নেই। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর করা একের পর এক মন্তব্যে বিব্রত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইভী ও শামীম ওসমানের পুরনো দ্বন্ধ আবারো প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। শামীম ওসমানকে গডফাদার আখ্যা দিয়ে দুদিন আগে আইভী বলেছেন তৈমূর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র কিংবা জনগণের প্রার্থী নয় তিনি শামীম ও সেলিম ওসমানের প্রার্থী। এ মন্তব্যের পর গতকাল সোমবার শামীম ওসমান এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। তবে তিনি প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে থাকার কথা বললেও তার বক্তব্যে ব্যক্তি আইভীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন আজ থেকে আমি নৌকার পক্ষে নামলাম। নারায়ণগঞ্জে জামায়েত বিএনপির ক্ষমতা নেই নৌকাকে ডুবাতে পারে। সকল মান অভিমান ভুলে তিনি সবাইকে নৌকার পক্ষে মাঠে নামার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে তৈমূর আলম বলেছেন আইভীর বক্তব্যে স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরাট বিভাজন রয়েছে। তারা নিজেরাই ঠিক নেই।
তৈমূর আলম বলেছেন ওসমান পরিবার নারায়ণগঞ্জে একটি ফ্যাক্টর সুতরাং একজন প্রার্থী হিসেবে আমি তাদের সমর্থন চাইতেই পারি। তার মানে এই নয় যে আমি শামীম ওসমানের পা দিয়ে হাটি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নৌকার পক্ষে নির্বাচন করার জন্য আমার নেতাকর্মীকে প্রশাসনিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
সিটি নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের বিভাজনের সুযোগ নিতে চাইছে তৈমূর আলম খন্দকার। তার সমর্থকরা মনে করছেন শামীম ওসমানপন্থীরা যদি আইভীবিরোধী, সেক্ষেত্রে তৈমূরের জয়ের পাল্লা অবশ্যই ভারী। অপরদিকে আইভী বলছেন নির্বাচনে শামীম ওসমানের সমর্থন জরুরি নয়। তাকে ছাড়াই জয় সম্ভব। আইভী সমর্থকদের দাবি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে আবারো মেয়র আইভীই হবেন। জনপ্রিয়তার বিচারে আইভীকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা এখনো তৈরি করতে পারেনি তৈমূর আলম। তাই নৌকার জয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
কয়েকদিন আগে সব বন্দর উপজেলার নির্বাচিত চার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে মেয়রপ্রার্থী তৈমূরের গণসংযোগে নামলে আইভীসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে বিরূপ মন্তব্য করেন। শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান দু’জনেই তৈমূরের পক্ষে কাজ করছেন ইউপি চেয়ারম্যানদের মাঠে নামা তা প্রমাণ করে বলে মন্তব্য করেন আইভী। তবে এ ঘটনার একদিন পরই কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টি ঘোষণা দেন নারায়ণগঞ্জে তাদের কোনো দলীয় মেয়রপ্রার্থী নেই সুতরাং তারা দলীয়ভাবে কাউকে সমর্থন দিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টিকেও কারো পক্ষে কাজ না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
তবে শামীম ওসমানকে আইভী গডফাদার বললেও শামীম ওসমান সাংবাদ সম্মেলনে বলেছেন কোনোভাবেই তার নৌকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি নৌকার পক্ষেই থাকবেন। তৈমূরের হাতি যতবড়ই হোক না কেন হাতিকে কোনোভাবেই নৌকায় উঠতে দেবেন না। জয় নৌকারই হবে।
নাসিক নির্বাচনে এবার মেয়র পদে লড়ছেন ৭ জন প্রার্থী। অন্যদিকে সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ১৮২ জন প্রার্থী। আগামী ১৬ জানুয়ারি সিটির ২৭টি ওয়ার্ডে একযোগে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
তৈমূরের নির্বাচনীয় সমন্বয়কারী গ্রেফতার
নারায়ণগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা :নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে আটক করেছে সিদ্ধিরগঞ্জ পুলিশ। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিলস্থ বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আবু বক্কর সিদ্দিকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। মনিরুল ইসলাম রবি স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের সিদ্ধিরগঞ্জের নির্বাচনীয় সমন্বয়কারী। রবিকে আটক করার বিষয়টি সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মশিউর রহমান নিশ্চিত করে বলেন, মনিরুল ইসলাম রবি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। যাচাই বাচাই করা হচ্ছে।
মনিরুল ইসলাম রবির মুক্তি জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখতে তাকে আটক করা হয়েছে। কোনো মামলা না থাকা সত্তে¡ও তাকে আটক করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন