টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি), বিদ্যুৎ বিভাগের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও ব্যর্থ হয়েছে রাজধানীর সড়কের ঝুলন্ত তার অপসারণে। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের মতো দুই সিটি করপোরেশনও অভিযান চালিয়ে তার কেটে এবং আল্টিমেটাম দিয়ে দায় সারছে। গত দেড় বছর ধরে তারা ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) ও ক্যাবল অপারেটরদের (কোয়াব) তার অপসারণের জন্য একের পর এক তারিখ বেঁধে দিচ্ছে। তবে কোনটিতেই কাজ হচ্ছে না। গতবছরের মার্চ মাসে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দেয়া সময় শেষ হওয়ার পর এখন কয়েকদিন পরপরই বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তার কেটে অপসারণ করছে ম্যাজিস্ট্রেট। তবে অভিযান শেষে ফের তার ঝুলিয়ে দিতে খুব কম সময়ই নিচ্ছে আইএসপি ও কোয়াব। যেখানেই তার কেটে অপসারণ করা হচ্ছে, সেখানেই কিছু সময় ফের তার ঝুঁলিয়ে দিচ্ছে তারা। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের দেয়া সময় গতবছর অক্টোবরে শেষ হওয়ার পর দীর্ঘদিন নীরব থেকে ফের আগামী জুন পর্যন্ত তার অপসারণের সময় বেধে দিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ফলে সড়কজুড়ে ঝুঁলে থাকা তারের জঞ্জালে ডিজিটাল সেবা কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী। অপসারণকে দুঃস্বপ্ন বলছেন নগরবাসী।
রাজধানীর সড়কে সৌন্দর্য বাড়াতে এবং কম খরচে নিরবিচ্ছিন্ন দ্রæতগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে ২০০৮ সালে ঝুলন্ত তার অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)। কমিশনের সাথে পরবর্তীতে এই উদ্যোগ সফল করতে যোগ দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এই দুই প্রতিষ্ঠান ১২ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েছে রাজধানীর জঞ্জাল সরাতে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিটিআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগ। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) ও ক্যাবল অপারেটরদের (ডিস সংযোগ প্রদানকারী) আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে বার বার। কমিটি গঠন করে মাঝে মাঝে দু’একটি অভিযান চালিয়ে কাটা হয়েছে ঝুঁলন্ত তার। কিন্তু সড়কগুলো আগের রূপ ফিরে পেতে সময় নেয়নি ২-৪ ঘণ্টার বেশি। বিটিআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যর্থতার পর ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তার অপসারণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কোন আল্টিমেটাম না দিয়ে তার অপসারণে মাঠে নামে ডিএসসিসি।
পূর্ব নির্দেশনা না দেয়া এবং বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ এনে ওই বছরের ১৮ অক্টোবর থেকে সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেয় আইএসপি ও কোয়াব। পরবর্তীতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আইএসপিবি ও কোয়াবের সাথে বৈঠকে আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচি স্থগিত করেন তাঁরা। এরপর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করে মাটির নিচ দিয়ে তার নেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয় এবং কর্মসূচি তুলে নেয় আইএসপিএবি। নভেম্বরের মধ্যেই তার মাটির নিচে নিতে আল্টিমেটাম দেয় দক্ষিণ সিটি। সেই সময়েও কাজ না হওয়ায় আবারও এক মাস সময় বাড়িয়ে দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। দক্ষিণ সিটির পক্ষ থেকে ওই সময় বলা হয় ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন রূপ পাবে সড়কগুলো। তবে সেই আল্টিমেটামও ব্যর্থ হলে ফের নতুন করে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সেটিরও প্রায় এক বছর হতে চললো। কিন্তু এখনো দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ধানমন্ডি এলাকার একটি সড়ক ছাড়া আর কোথাও তার মাটির নিচে নেয়া হয়নি। তবে মাঝে মাঝে দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক অভিযান চালিয়ে তার কেটে অপসারণ করছে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি চলে যাওয়ার সাথে সাথেই আবার ওই একই স্থানে তার তুলতে চলে আইএসপি ও কোয়াবের কর্মযজ্ঞ। আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই সেই সড়ক ফিরে পায় পুরনো রূপ।
জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, আইএসপি ও কোয়াবকে বার বার সময় দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা কোন কথা রাখেনি। তাই এখন আর এসব বিষয়ে কোন আলোচনা হচ্ছে না, দক্ষিণ সিটির অবস্থান হলো যেখানে ঝুলন্ত তার পাওয়া যাবে তা অপসারণ করা হবে। তিনি বলেন, আইএসপি ও কোয়াব নানাভাবে চেষ্টা করছে কথা বলার জন্য, তারা সময় চাইছে।
ঢাকা দক্ষিণ জঞ্জাল সরাতে যতটা সরব উত্তর সিটি ততটাই নীরব। মেয়র আতিকুল ইসলাম নতুন মেয়াদে দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর হাতে গোনা দু’একদিন তার অপসারণের অভিযান চালান। তবে তিনি আইএসপি ও কোয়াবের আবেদনের প্রেক্ষিতে একের পর এক আল্টিমেটাম দিচ্ছেন, বাড়াচ্ছেন তার অপসারণের সময়সীমা। এর আগে গতবছরের অক্টোবর পর্যন্ত ঝুলন্ত তার নামিয়ে ফেলার সময়সীমা বেধে দেন। অন্যত্থায় সিটি করপোরেশন তা সরিয়ে ফেলবে বলে হুমকীও দেন। কিন্তু অক্টোবরের পর দীর্ঘদিন আর এ বিষয়ে কোন উদ্যোগই নেননি তিনি। তবে হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার উত্তর সিটির এক সভায় মেয়র আতিকুল ইসলাম আবারও এসব তারের জঞ্জাল সরিয়ে নিতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেন আইএসপি ও কোয়াবকে। তিনি বলেন, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকা থেকে সব ঝুলন্ত তার আগামী ৩০ জুনের মধ্যে অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে জানান তিনি।
মেয়র বলেন, ঝুলন্ত তার সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মাটির নিচে (ভূগর্ভে) স্থানান্তর করতে হবে। এ নিয়ে নির্দেশনা থাকলেও সেটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। যে কারণে নগরের অলিগলিতে এখনো এলোমেলোভাবে ক্যাবল টেলিভিশনের তার (ডিশলাইন) ও ইন্টারনেটের সংযোগ ঝুলছে।
তার অপসারণে উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা বলেন, আমরা অনেকগুলো রাস্তার ঝুলন্ত তার ইতোমধ্যে অপসারণ করেছি। তিনি বলেন, এখানে আসলে অনেকগুলো ইস্যু জড়িত। এখানে স্টেকহোল্ডার কারা? তার নামাতে গেলে ইন্টারনেট, ডিস সব একসাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এগুলোতো (ঝুলন্ত তার) মাটির নিচে নিতে হবে। এটাতো চাট্টিখানেক কথা না। মাটির নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডে সরানো, কাজ করা, তারপর তারগুলো সরানো। তারতো কেটে দিলেই হলো না। আমরাতো অনেকগুলো রাস্তার তার কেটে দিয়েছি। এখন তারা নিজেদের তার নিজেরা কাটছে। এটাতো একটা চলমান প্রক্রিয়া। একদিনেতো এই জঞ্জাল তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের এই জঞ্জাল একদিনে-দুইদিনেতো সরানো যাবে না। মেয়র বললেই সবকিছু হয়ে যায় না। কারণ বাচ্চাদের পরীক্ষা ইন্টারনেট লাগবে। এখন ইন্টারনেট ছাড়া কোন ক্লাস-পরীক্ষা হয় না। সবদিক থেকে মানবিক বিষয়গুলো সামনে আসছে। আবার ঝুলন্ত তারও সরাতে হবে। যেমন আমরা নতুন এলাকাগুলোতে সব তার আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার কনষ্ট্রাকশনই এখন সেভাবে হবে। যত আমরা সামনের দিকে যাচ্ছি, তত আধুনিকায়ন হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ জুনের মধ্যে আমরা এবার বোধহয় পারবো।
সিইও আশা প্রকাশ করলেও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠন আইএসপিএবি’র সভাপতি এমদাদুল হক বলছেন ভিন্ন কথা। ঢাকা শহরের তার অপসারণে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এমদাদুল হক বলেন, প্রথমে আমরা দুই বছর সময় চেয়েছিলাম। এর মধ্যে করোনার কারণে কাজ করতে পারিনি। উত্তর সিটিতে ৬০টি প্রধান সড়কের মধ্যে ৪০ ভাগ কাজ হয়েছে। টঙ্গী থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত প্রধান সড়ক, উত্তরা ৪নং সেক্টর, গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে পাকিস্তান অ্যাম্বাসিসহ আরও বেশ কিছু সড়কের তার মাটির নিচে নেয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আরও কয়েকটি সড়কের তার সরিয়ে নেয়া হবে। ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রধান সড়কগুলোর তার অপসারণ সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
দক্ষিণ সিটির বিষয়ে আইএসপিএবি সভাপতি বলেন, ধানমন্ডির একটি সড়কে মাটির নিচে তার নেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটির কাজ শেষ পর্যায়ে, মেয়র সময় দিলে সেগুলো কেটে নামানো হবে। বাকীগুলো করতে আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগবে। তিনি জানান, মেয়রের সাথে তারা সাক্ষাত করেছেন, তিনি একটি প্ল্যান চেয়েছেন। এরপর বসে চূড়ান্ত করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন