শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মানসিক অসুস্থদের ইতিবাচক থাকতে সাহায্য করতে হবে

শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, উত্ত্যক্তকরণ, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা, মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ আত্মহত্যা ঘটে। প্রচারমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতিপ্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কখনো কখনো আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে পারে। আত্মহত্যার প্ররোচণার অর্থ এমন পরিস্থিতি সচেতনভাবে সৃষ্টি করা, যা পীড়িত মানুষটির সামনে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই অবশিষ্ট রাখে না। নিদারুণ অপমানের শিকার হয়ে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে বহু মানুষকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখা যায়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান। তার আগে তিনি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। সেসময় জীবনের নানা হতাশা ও দুঃখের কথা তুলে ধরেন তিনি। তার এ আত্মহত্যা হতবাক করেছে পুরো জাতিকে। সচেতন সমাজ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এ নিয়ে সরব। শুধু মহসিন খানই নন, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আত্মহত্যার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ এবং প্রকাশ করছে। বিবিএস-এর হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৫ জন আত্মহত্যা করছেন। এটাকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২ দশমিক ৪ শতাংশে কমিয়ে আনার টার্গেট নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে সামাজিকভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে বিবিএস।
বিবিএস সূত্র জানায়, বর্তমানে (২০২০ সালের জরিপ) প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৫ জন আত্মহত্যা করেন। সে সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যা ধরা হয় ১৭ কোটি ১৬ লাখ। ২০২০ সালে সারাদেশে মোট ১৩ হাজার ৮১৪ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের গড় প্রায় সমান।
২০১৯ সালে প্রতি লাখে আত্মহত্যার হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তখন দেশের মোট জনসংখ্যা ধরা হয়েছিল ১৬ কোটি ৫৯ লাখ। সে হিসাবে ওই সময়ে দেশে ১২ হাজার ৯৫৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছিলেন। এতেই স্পষ্ট হয়, দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে।
২০১৫ সালে দেশে প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৬৮, ২০১৬ সালে ৭ দশমিক ৮৪, ২০১৭ সালে ৩ দশমিক ৭৯ ও ২০১৮ সালে ৭ দশমিক ৬৮ জন আত্মহত্যা করেছিলেন। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লাখে আত্মহত্যার হার ৭ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এটা এখন ৮ জনের ওপরে চলে এসেছে।
বিবিএস সূত্র জানায়, ২০২১ সালের প্রথম ১০ মাসে দেশে মোট মৃত্যুর কিছু কারণ খুঁজে বের করে বিবিএস। ১০ মাসে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তখন ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। মহামারির এ সময়ে দেশে শুধু হার্ট-অ্যাটাক, হার্ট-ফেইলিওর ও হৃদরোগে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন। আর পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, বছরে গড়ে ১০ হাজার মানুষ ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। এর বাইরে ঘুমের ওষুধ সেবন, ছাদ কিংবা উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়া কিংবা রেললাইনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো ঘটনাগুলোও বিরল নয়।
আত্মহত্যা করার কতো গুলো কারণ রয়েছে। যেমন জেনেটিক, হঠকারিতা বা ইমপালসিভিটি, মানসিক রোগ, প্রত্যাশার মানসিক চাপ, পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য, রাত জাগার বদভ্যাস, মাদকাসক্তি, জুয়া খেলা, দীর্ঘমেয়াদি পীড়াদায়ক রোগ এবং প্রেমে ব্যর্থতা।
সম্প্রতি একটি আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আত্মহননকারী ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের পরিবারের সদস্য, সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই চরম হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছেন। ফেসবুকে লাখো-কোটি মানুষ তাঁর আত্মহত্যার ভিডিওটি দেখেছেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের মানবিক বোধগুলো কি তবে এতটাই ভোঁতা হয়ে গেছে যে কোনো কিছুই এখন আর আমাদের স্পর্শ করে না! ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনাকালে একটি জরিপ করেছিল আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা গেছে, ওই সময় দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। জরিপ মতে, বিশ্বের পুরুষ আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করেন। নারী ৫৭ শতাংশ, পুরুষ ৪৩ শতাংশ। কোনো ব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে আত্মহত্যা করেন না। অনেক কারণ থাকে এর পেছনে। এ থেকে প্রতিকারের জন্য আমাদের সবাইকে ডিপ্রেশন (মানসিক অসুস্থতা) সম্পর্কে জানতে হবে। তাহলে ডিপ্রেশনে থাকা মানুষকে আমরা সহায়তা করতে পারব। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির পাশে যখন কেউ থাকে, তখন তিনি স্বাভাবিক থাকেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বলা বাহুল্য, একাকিত্ব মানুষকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দেয়। একাকিত্ত থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই আপনাকে কাজের ভিতর থাকতে হবে। একাকিত্ব দূর করতে যতটা সম্বব বন্ধুদের সাথে মিশুন, তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলেন। কোনভাবেই একা একা থাকা যাবে না। পরিবারকে সময় দিন, তাদেরকে আপনার মনের কথা খুলে বলেন। এসব ক্ষেত্রে পারিবার অনেক বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারে।
আল কুরআন ও হাদিসে বাবা-মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। অন্যদিকে, অবহেলিত বাপ-মার দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করে। পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তাঁর বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। তা ছাড়া সন্তান তাঁর মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন।
পরিশেষে বলছি, বর্তমান সময়ে আমরা পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। তাদের বাড়তি বোঝা ভাবতে শুরু করেছি। বাবা-মার প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ প্রায়ই করতে পারছি না। এসবেরই নানাবিধ সামাজিক বিষফল এখন দেখা দিচ্ছে। এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তির উপায় আমাদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক-সমাজিক বন্ধন অঁটুট রাখা। সেদিকে নজর দেয়া জরুরি।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ পিএম says : 0
গোড়া কেটে মাথায় পানি দিলে গাছ বাঁচে না আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছে এবং আল্লাহ জানে আমাদের কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেজন্য আল্লাহ কোরআন নাজিল করেছেন এবং আমাদের নবী আমাদেরকে দেখিয়েছেন কিভাবে ব্যক্তিগত জীবন পারিবারিক জীবন রাষ্ট্রীয় জীবন ও পররাষ্ট্র জীবন কিভাবে পরিচালনা করতে হবে আজকে আমাদের দেশে চলে .......... আইন দিয়ে যত ধরনের অন্যায় অবিচার হতেই থাকবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন